আগের পর্ব শুনুন বা পড়ুন:
Durga-র খোঁজে… গার্গীর সঙ্গে - ৪
মা দুর্গার খোঁজে… সঙ্গে গার্গী-৩
মা দুর্গার খোঁজে… সঙ্গে গার্গী-২
ন্যারেটর – আজ পুজো শেষ। যদিও আমি বিশ্বাস করি না, মায়ের পুজো কখনও শেষ হতে পারে। তাই আজও চলবে আমাদর টাইম ট্র্যাভেল। আমি গার্গী রায়চৌধুরি। আজ আমরা ঘুরব সেই সময় থেকে এই সময়, পুরনো কলকাতা থেকে আজকের তিলোত্তমা। শুনব, কী ভাবে বদলাল আমাদের প্রাণের দুর্গা পুজো।
(ট্র্যান্জিশন)
ন্যারেটর – শুরুর দিকে ব্ল্যাক জামিন্দার গোবিন্দরাম মিত্তির বা ‘মহারাজা’ নবকৃষ্ণ দেব-এর মত বড়মানুষদের দরদালানেই হতো মায়ের পুজো। সাধারণ মানুষের থেকে বেশ কিছুটা দূরেই ছিল সে উৎসব। আজকের পাড়ায় পাড়ায় থিমের পুজো আর জনসাধারণের অবাধ পার্টিশিপেশনের সঙ্গে কোনোমতেই মেলানো যায় না সেকালের পুজোকে।
ছবিটা কী ভাবে বদলাল, তা জানার জন্য আমাদের যেতে হবে কলকাতা ছেড়ে শ’খানেক কিলোমিটার দূরে, হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ায়। সালটা ১৭৯০। শুনে নিই না গবেষক বিজলীরাজ পাত্র এ বিষয়ে কী বলছেন…
(ট্র্যান্জিশন)
বিজলী - যা শোনা যায় তার মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ঘটনাটা হল, জমিদারমশাইয়ের মোটাসোটা চেহারা অথবা তাঁর কোনও বেফাঁস মন্তব্য নিয়ে গ্রামের আড্ডায় বিস্তর ঠাট্টা-তামাসা জুড়ে দেন কয়েকজন বন্ধু। সংখ্যায় এঁরা ছিলেন ১২ জন। এঁদের নাম জমিদারের কান পর্যন্ত পৌঁছতে দেরি হয়নি। রসিকতার ধরনও যথাসম্ভব ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তাঁর কানে তোলা হয়েছিল। ব্রাহ্মণ তো কী হয়েছে, জমিদারকে অসম্মান! পুজোর সময় এর শোধ তোলার মতলব করেন জমিদার। বাড়ির দারোয়ানদের ওপর কড়া নির্দেশ ছিল, বাড়ির চৌকাঠ যেন পার করতে না পারেন ওই দুর্বিনীতের দল। তা ওই বন্ধুরা দল বেঁধে ঠাকুরদালানের দিকে এগোতে গেলে বাড়ির ফটক থেকেই ঘাড় ধরে বার করে দেওয়া হয় তাঁদের। সেই দিনই তাঁরা প্রতিজ্ঞা করেন, যত সামান্যই হোক, ওই গ্রামে আরও একটা পুজো হবে, জমিদারবাড়ির বাইরে। বারো বন্ধু বা ইয়ার মিলে সাধ্যমতো পয়সা জোগাড় করে সত্যিই পরের বছর পুজো করেছিলেন। বারো ইয়ারের তৈরি ওই পুজোর খবর ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি, কলকাতা থেকেও বাবুরা এসে অবাক হয়ে দেখে গিয়েছিলেন প্রথম বারো-ইয়ারি পুজো। প্রথম ওই বারোয়ারি পুজোয় মা দুর্গার বিন্ধ্যবাসিনী রূপের আরাধনা করা হয়েছিল। অভূতপূর্ব ওই পুজোর খ্যাতি এমন ছড়িয়েছিল যে শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত ফ্রেন্ডস অফ ইন্ডিয়া পত্রিকায় তার বিস্তারিত রিপোর্ট পর্যন্ত ছাপা হয়। ধনীদের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াও এমন জাঁকজমক করে দুর্গাপুজো যে করা যায়, গুপ্তিপাড়া সেই পথ দেখাতেই বিভিন্ন জায়গায় শুরু হয়ে গেল বারোয়ারি পুজোর পর্ব। কয়েক বছরের মধ্যেই পর পর চুঁচুড়া, শান্তিপুর, কাঁচড়াপাড়া এবং অবশেষে কলকাতায় বারোয়ারি পুজো নিজের জায়গা করে নিল।
ন্যারেটর - ১৮৩২ সালে জ্ঞানাম্বেষণ পত্রিকা রিপোর্ট বার করে কলকাতার পুজোর এমনই দুরবস্থা যে কুমোরটুলির বেশির ভাগ প্রতিমাই বিক্রি হয়নি। সে বছর কলকাতায় এক নতুন রেওয়াজের জন্ম হল। রাতের অন্ধকারে ছেলে-ছোকরার দল কুমোরটুলির বিক্রি না হওয়া প্রতিমা নিয়ে বিভিন্ন গৃহস্থের বাড়ি বাড়ি রেখে আসতে শুরু করল, যাতে যত সামান্য ভাবেই হোক না কেন, অন্তত পুজোটা সম্পন্ন হয়। এরপরই ১৮৩৩-এ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ঘোষণা করল, নেটিভদের পুজো থেকে হাত তুলে নিচ্ছে তারা। এর চার বছর পরই ১৮৩৭-এ দুর্গাপুজোয় ফোর্ট উইলিয়ম থেকে তোপ দাগা-ও বন্ধ হয়ে গেল।
মহানগরের দুর্গাপুজোয় আভিজাত্যের শেষ ছটাটুকু কোনওক্রমে টিকে ছিল উনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষ পর্যন্ত। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই স্বদেশী আন্দোলন ক্রমশ মাথাচাড়া দিতে শুরু করল। প্রায় প্রতি পুজোই হয়ে উঠল বিপ্লবীদের জনসংযোগ এবং নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখার মূল কেন্দ্র। অনুশীলন সমিতির দুই সদস্য পুলিনবিহারী দাস ও অতীন্দ্রনাথ বসু পর পর ১৯২৬ ও ১৯২৮-এ তৈরি করলেন সিমলা ব্যায়াম সমিতি আর বঙ্গীয় ব্যায়াম সমিতি। দু’জায়গাতেই শুরু হলো দুর্গাপুজো। পুজোর মাধ্যমে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং আড়ালে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার যে কায়দা কলকাতায় শুরু হয়েছিল, তাতে প্রথম থেকেই যুক্ত ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু-ও। কিন্তু ১৯২৫-এ তাঁকে গ্রেপ্তার করে মান্দালয় জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হল। এবং কী আশ্চর্য, সেখানেও সুভাষ দুর্গাপুজো করতে চান। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার যে অনড়। প্রিয় বৌদি, বাসন্তী দেবীকে তিনি একটি চিঠি লিখলেন…
সুভাষ – আজ রাতে জেলে আমরা কেউ মুখে অন্ন তুলব না। চিন্তা করবেন না, দেবী মা আমাদের ঠিক খেয়াল রাখবেন। আমাদের কিচ্ছু হবে না। আর কেনই বা অনশন করব না, হ্যাঁ? কী অন্যায় দাবি করেছি আমরা? চেয়েছি তো শুধু জেলে দুর্গা পুজো করতে। আমরা সবাই মিলে ১৪০ টাকা করে নিজেরা জমিয়েছি, হাতে ৮০০ টাকা মতো এসেছে, সরকারের কাছ থেকে ৬৬০ টাকা গ্র্যান্ট হিসেবে মাত্র চেয়েছি। তাও ওরা দেবে না? কেন, ক্রিশ্চান বন্দিদের তো ১২০০ টাকা মতো গ্র্যান্ট দেওয়া হয়, পবিত্র কাজের হেতু। তা হলে আমাদের সঙ্গে এ অন্যায় কেন? তাই যত ক্ষণ না আমরা মা’কে পুজো করার অনুমতি আদায় করতে পারছি, এ হরতাল চলবে।
ন্যারেটর – সুভাষচন্দ্র বসু’র এ অনশনের কী ফল হল জানেন? ব্রিটিশ সরকারকে মাথা নোয়াতেই হল। জেলেই মায়ের আরাধনা করলেন সুভাষ।
মুক্ত হয়ে কলকাতায় ফেরার পর, ১৯৩৮ এবং ১৯৩৯ — পর পর দু’বছর বাগবাজার সর্বজনীন পুজো কমিটির সভাপতির পদও অলঙ্কৃত করেছিলেন নেতাজী।
এর পর এল আর এক অধ্যায়। দুর্গা পুজোকে স্বদেশী আন্দোলনের সমার্থক করে তুলে, প্রতিমাকে খাদির শাড়ি পরিয়ে জনমানসে বিলিতি কাপড় বর্জনের ডাক দিলেন সিমলা ব্যায়াম সমিতির সদস্যরা। খাদি পরা প্রতিমা দেখতে গোটা কলকাতা ভেঙে পড়ল সিমলায়। সে বছর সিমলা ব্যায়াম সমিতির প্রতিমা প্রসিদ্ধি লাভ করল ‘স্বদেশী ঠাকুর’ নামে। আর দেরি না করে সিমলার পুজো বন্ধ করে দেওয়ার প্রশাসনিক নির্দেশ এল। পুজো প্রাথমিক ভাবে বন্ধ হয়ে গেলেও কয়েক বছর পর ওই পুজো ফের চালু হয়। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বীরাষ্টমী পালনের প্রথা আর ধরে রাখা যায়নি। লাঠিখেলা-র ওই প্রথা এখন একমাত্র বাগবাজারেই পালন করা হয়।
এ কালের পুজোয় এক অভিনব পালক যোগ হলো আশির দশকের মাঝামাঝি, মেক্সিকো উঠে এল কলকাতায়!
মারাদোনাকে নিয়ে কলকাতা তখন পাগল। মেক্সিকোতে বিশ্বকাপ জিতেছে আর্জেন্টিনা। তাঁর স্কিল, তাঁর গোল– আলোর খেলায় উঠে এলো কলকাতার দুর্গাপুজোয়। সৌজন্যে চন্দননগরের আলোকশিল্পীরা। তাদের হাত ধরে নতুন ভঙ্গিতে সাজতে শুরু করল কলকাতার নামকরা পুজোগুলো। ‘চন্দননগরের লাইটিং’ কথাটা সমার্থক হয়ে উঠল কলকাতার পুজোর সঙ্গে।
এর পর এল থিম, গ্লোবালাইজেশনের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে, দুর্বার গতিতে। কলকাতায় বসেই কখনও আঙ্কোরভাট কখনও গিজার পিরামিড— বিশ্বদর্শন শুরু হল কলকাত্তেওয়ালিদের। তবু, সেই রুকু থেকেই গেল মনের ভেতরে কোথাও, যে কখনও বড় হয় না এই পাঁচ দিনে— আমাদের মুখের আলো এখনো ম্লান করে দেয় মেগাওয়াটের যত হ্যালোজেন-কে আজও।
এই থাক। এ ভাবেই থাক। আসছে বছর আবার হবে বলতেই বলতেই আনন্দে বিষাদে কলকাতায় ঢাক বাজতে থাকুক এ ভাবেই আজন্মকাল।
দুগ্গা দুগ্গা…
শুভ বিজয়া।
‘এই সময় গোল্ড অরিজিনালস’-এর নিবেদন
মা দুর্গার খোঁজে… সঙ্গে গার্গী
সূত্রধর: গার্গী রায়চৌধুরী
লেখা: ঈশান বন্দ্যোপাধ্যায়, কুবলয় বন্দোপাধ্যায়
অভিনয়: বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী, শৌণক সান্যাল, রূপসা রায়, অনির্বাণ ভট্টাচার্য
বিশেষ কৃতজ্ঞতা: নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী ও বিজলীরাজ পাত্র
সাউন্ড ডিজাইন: সুশান্ত দাস
এগজিকিউটিভ প্রোডিউসার: অনির্বাণ ভট্টাচার্য
Eisamay Gold/bengal festivals/ei samay gold special podcast on history of durga puja part 5