Debojyoti Mishra : বইয়েই গেল, দেবজ্যোতি মিশ্র-র সঙ্গে

fontIcon
Kolkata Book Fair
10 Feb 2023, 06:30:35 AM IST
Image Source: iStock

ওই ডাকছে বই! বই তো ডাকে— সাদা পাতার গন্ধে, রংচঙে মলাটে, সাজানো আখরে। তবে জানুয়ারির শেষ থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম দুটো সপ্তাহ সেই ডাক যেন হাতছানি হয়ে ওঠে। শহর তখন প্রবল ভাবে ময়দান থুড়ি মিলন মেলা থুড়ি সেন্ট্রাল পার্ক-মুখী। তেরো পার্বণের একটাও কি মিস্ করলে চলে! অলিতে-গলিতে, মাঠে-ময়দানে, রোয়াকে-ঠেকে বইয়ের মেলা নিয়ে গুজগুজ-ফুসফুস। কেমন বই? কীসের বই? কত বই? কথায়-কথায় শুনে নিই লেখকদের মুখ থেকেই। আর, তাঁদেরও যে কিছু উইশ লিস্ট থাকে, অন্য লেখকদের জন্য। ৪৬তম আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তকমেলার ক’টা দিন কথাবার্তা চলুক বই নিয়েই, না কি? এই সময় গোল্ড অরিজিনালস-এর নিবেদন ‘বইয়েই গেল’। আজ শুনব দেবজ্যোতি মিশ্র-র কথা।

আরও শুনুন বা পড়ুন:
বইয়েই গেল, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়-এর সঙ্গে
বইয়েই গেল, অনুপম রায়-এর সঙ্গে

Debojyoti Mishra Book Release  : 

প্রশ্ন: আপনার যে নতুন বই, অর্থাৎ সত্যজিৎ রায়ের মিউজিক নিয়ে যে বইটা, এইটা নিয়ে যদি আপনি বলেন। কী ভাবনা থেকে বইটা তৈরি হল, মিউজিকের ঠিক কোন গতিপথটা আপনি ধরতে চাইছেন, শতবর্ষে সত্যজিৎ রায়কে কী ভাবে দেখলেন…

উত্তর: শতবর্ষে সত্যজিৎ, সত্যজিতের মিউজিক… আমার মনে হয়েছে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার সবচেয়ে বড় কন্ট্রিবিউশন, ভারতবর্ষের চলচ্চিত্রে তাঁর সবচেয়ে বড় কন্ট্রিবিউশন, তাঁর মিউজিক। এটা আমার মত। এই ভাবনাটা আমার এল, যখন ‘ঘরে-বাইরে’ ছবিতে এক জন ভায়োলিনিস্ট হিসেবে সত্যজিতের সঙ্গে বাজাচ্ছি। তখন ‘একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ’ গানটা ব্যবহার করেছিলেন। গানের কথা নয়, সুরকে ব্যবহার করে গানের যে অর্কেস্ট্রেশন করেছিলেন, আমি পার্ট অফ দ্য অর্কেস্ট্রেশন ছিলাম, সেটা আমার মনে হয়েছিল, কী অসাধারণ একটা অর্কেস্ট্রা স্কোর তৈরি করলেন এত দিনের চেনা একটা গানের মধ্যে থেকে। যার সমস্তটা, যে অন্দর মহল থেকে বাহির মহলে এলেন আমাদের বিমলা, এমন একটা গ্লো, যে উজ্জ্বল আলোর মতো হল, আবার কোথাও যেন একটা, যে অর্কেস্ট্রেশনের মধ্যে একটা পেনসিভ ব্যাপার তৈরি করলেন… একটা সেতার দীপক চৌধুরী বাজাচ্ছেন, সেতারের উজ্জ্বল একটা স্বর— তার সঙ্গে যখন ভায়োলিন, ভিয়োলা, চেলো ব্যবহার হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে অদ্ভুত একটা ইউরোপিয়ান বিষণ্ণতা আছে। এইটা আমাকে মুগ্ধ করেছিল, এবং আমি প্রায় ওই দিন থেকেই বইটা লিখতে আরম্ভ করেছি, মনে-মনে।

একটা বড় জার্নি আছে সত্যজিৎ রায়ের। এবং শতবর্ষ একটা তাড়া দিয়েছিল, একটা আলাদা তাগিদ তৈরি করেছিল যে, শতবর্ষে অন্তত বইটাকে আনব, এবং দে’জ থেকে অপু অসম্ভব আমাকে সহায়তা করেছে, এবং প্রত্যেকে যারা আছে তারা সাহায্য করেছে। এই বইয়ের মধ্যে সাত্যকি আমাকে ছবির পারমিশন দিয়েছে, মিউজিকের যে স্কোর করতেন তাঁর যে ছবি, এই সব ছবি আমি পেয়েছি, এবং সেটা আমার কাছে খুবই ইম্পর্ট্যান্ট। আমি নিজে ছবি এঁকেছি, যে হেতু আমি আঁকার মধ্যে আছি।

আমার আরও অনেক কিছু মনে হয়েছে। যেমন ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর ভূতের দৃশ্যের ওই মিউজিকটা, ছ’মিনিটের একটা মিউজিক চলছে, এবং তার মধ্যে অনেক রকমের ভূত আছে। এখান থেকে মরে গিয়ে যারা আসছে, তার মধ্যে ব্রাহ্মণ ভূত আছে, তার মধ্যে সাহেব ভূত আছে, বিভিন্ন ক্লাস… এই ক্লাসিফিকেশন অনুযায়ী তাদের একটা বাজনা বাজছে। সেটা আমার কাছে খুব মজার লেগেছে, সেগুলোকে ব্যবহার করা, ছ’মিনিট কী করে ধরে রাখতে পারা যায় ব্যাপারটা, কিন্তু ধরে তো রাখতে পেরেছেন। তার পর যখন রাত্রিবেলা স্বপ্নে বর পেল তারা, সেটা কি স্বপ্নে বর পেয়েছিল না সত্যিকারের এসেছিল, তার পরের দিন সকালবেলা উঠে গুপী সেই কুয়াশার সকালে, শীতের সকালে সে, তার মনে আছে স্বপ্নের খানিকটা যে সে একটা বর পেয়েছে। এ বার সে গাইতে আরম্ভ করল। সেই প্রথম সে প্রথম ‘সা’ গাইল।
 গাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার মনে হল, কী যেন একটা ভিতরে ঝমঝম করে উঠল, তার পরেই সে পঞ্চম স্বর ‘পা’ গাইল, সারা পৃথিবীর থেকে যেন প্রতিধ্বনি এল, এবং গুপীকে বিহ্বল করে তুলল। তার মনে হল এত তার সুরে লাগানো হয়েছে, এত দিন তার মনে গান ছিল, কিন্তু সেই গান কণ্ঠে এনে মানুষকে ভালো লাগানো… গুপীর এই প্রথম মনে হল, এই গান যেন শোনার, সারা প্রান্তর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। এই যে সাধারণ একটা ব্যবহার, তার অনেক কারুকাজ করলেন না সত্যজিৎ। দেখো রে, নয়ন মেলে… সাগাপা… মাগামা পা… কী অসাধারণ! মা গা রে সা নি সা… এ রকম আমাদের এত চেনা একটা ভৈরবী, গুপীর জন্য যেন নতুন করে সুর বাঁধল। ভৈরবী নিজে, ভৈরবী রাগিণী যেন গুপীর জন্য নতুন করে গেয়ে উঠলেন। এটা তো সত্যজিৎই তৈরি করছেন।

এই অনেক কিছু মিলে, মানে থিম কী করে ব্যবহার হয়… ফেলুদা বললে পরেই আমাদের ‘ধান ধা তিরা রা পাম পাম সা রা তা তা রে’… এটা কোথা থেকে যে মোৎজার্ট, বাখ, মোৎজার্ট-এর টুয়েন্টি ফিফথ সিম্ফনি এই সমস্ত কিছু শোনার অ্যাকুমুলেশন, এই পয়েন্টটা তৈরি করছে, এটা আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে। এবং আমি ছবিগুলি থেকে বহু কিছু, প্রায় সমস্ত ছবিই ধরে করেছি। কিছু ছবি বাদ গেছে। যেটা সত্যজিতের কম্পোজিশন, আমার মনে হয়েছে, এটা সত্যজিৎ না-ও হতে পারে, মানে সত্যজিৎ না করলেও অন্য কেউও করতে পারে। সেই দু’-একটা ছবি বাদ দিয়ে বাদবাকি সমস্ত ছবি ধরে ধরে, এবং একটা গল্পের মতো করে, খুব সাধারণ মানুষ যাতে পড়তে পারে, পড়ে ভালো লাগে, এবং পড়ে যেন একটা দৃশ্য উঠে আসে, সে যেন আবার ছবিগুলোর কাছে ফিরে যায়। এই মিউজিকগুলো তখন সে শুনবে সাবলীল ভাবে।

যেমন ‘মণিহারা’। মণিহারাতে মণি কোন পরিবার থেকে এসেছে? যে পরিবার থেকে এলে একটা রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া যায়, সেই সময় ছিল। কিন্তু ‘বাজে করুণ সুরে’ এমন একটা পরিবার থেকে আসবে, যেখানে ‘বাজে করুণ সুরে’ গানটা সে শিখেছে। এখানে সত্যজিৎ একটা লাইসেন্স দিলেন, ওকে গানটা দিলেন, এ বার বাজে করুণ সুরে কী রকম রয়েছে? এ বার যখন ওই ঘটনাগুলো ঘটতে আরম্ভ করবে। ভূতুড়ে ব্যাপারস্যাপার হতে আরম্ভ করবে, হ্যালুসিনেট করতে আরম্ভ করবে, এবং হ্যালুসিনেশনের মধ্যে দাঁড়িয়ে ওই বাঁশি বাজিয়েছিলেন, এই যে নি সা নি ধা পা মা তৈরি করার জন্য অনেক আগে উনি একটা বীজ পুঁতলেন যে, মণিকে দিয়ে এই গানটা গাওয়ালেন, এই গান গাওয়ানোর মধ্যে একটা বিষণ্ণতা রয়েছে, সম্পর্কের শীতল অনুভূতি রয়েছে, আর একই সঙ্গে কোথায় যেন একটা নেমেসিস-কে দাঁড় করানো রয়েছে। এটা সত্যজিৎ তৈরি করছেন, এটা তো মণিহারা গল্পে ছিল না। এবং তৈরি করে উনি সেটার থেকে কী ভাবে থিম ডেভলপ করছেন, সেইগুলো আমার মনে হয়, ভারতবর্ষের চলচ্চিত্র সঙ্গীতে ঘটেনি।

তাই আমি লিখেছি, এবং আমি মনে করি, আমি শুরু করলাম, আরও অনেক মানুষ আসবে, তারা পরবর্তী সময়ে কাজ করবে। তবে এই বইটা সবার জন্য, কারণ এ ধরনের কোনও বই ছিল না। সুধীর চক্রবর্তীর একটি বই আছে, তবে সেটা অন্য রকম ভাবে লেখা। এই বইটার মধ্যে একদম খুব সরল ভাবে লেখা, এর মধ্যে স্বরলিপি রয়েছে, তিনটে-চারটে করে লাইন রয়েছে। তাই আমার মনে হয় ‘কম্পোজার সত্যজিৎ’ মানুষ নিলে তার এমনিও ভালো লাগবে, স্বরলিপি না পড়লেও তার ভালো লাগবে।


Web Title:

Kolkata Book Fair 2023 | Kolkata Book Fair special | Debojyoti Mishra New Release | দেবজ্যোতি মিশ্র-এর কথা

(Bengali podcast on Eisamay Gold)

গল্প রেট করুন