উত্তম কুমার যখন ভিলেন

fontIcon
STREE
24 Jul 2021, 07:00:00 PM IST
Image Source: BCCL

নায়ক হিসেবে অভিনেতা উত্তমকুমার যে অনবদ্য, তা নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না। কিন্তু খলনায়ক? স্বল্প যে ক’টি সিনেমায় তিনি খলনায়কের চরিত্র করেছেন, প্রতিটিতেই রেখে গিয়েছেন স্বকীয়তার ছাপ। কেমন সে সব চরিত্র?

‘বাঘবন্দি খেলা’র উত্তমকে তৈরিই করা হয়েছে পাক্কা ক্রিমিনাল হিসেবে। সে একটু মুটিয়েছে ততদিনে। বারান্দায় বসে খেতে খেতে সে মাংসের পিস গুনবে, ছেলেমেয়েদের আদরযত্ন বা স্ত্রীয়ের দেখাশোনা করবে না, অসৎ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে, সেটা ছবির গোড়া থেকেই পরিষ্কার। সে চড়া গলায় কথা বলে, বাংলা ছবিতে লম্পট বোঝাতে যে রকম মেকআপ দিতে হয়, তাও তার গোঁফে জুলফিতে শোভা পাবে। তার চাইতেও যেটা বড় কথা, পারিবারিক কৌলিন্য না থাকার ফলে একেবারে নিচুতলার মানুষের যে নৈতিক দায়গুলি থাকার কথা নয়, সেগুলিকেও চরিত্রটি ঝেড়ে ফেলে শুরু থেকেই। এটি বহুচর্চিত ছবি, এবং উত্তমের চরিত্রটিও দর্শকদের মনে গভীর রেখাপাত করেছিল সত্তরের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে। ভালো, সততা এবং সত্যের প্রতি একনিষ্ঠ কিছু চরিত্রও ছিল বটে ছবিটায়, তবে তারা উত্তমের বলিষ্ঠ অভিনয়ের সামনে টিকতে পারেনি।

কিছুটা আগের ছবি ‘শেষ অঙ্ক’। বাংলায় এ ধরনের ছবি খুবই কম হয়েছে। তার চাইতেও যেটা বড় কথা, যে ছবিগুলো নিয়ে বাংলায় সবচাইতে কম কথা হয়েছে, ‘শেষ অঙ্ক’ সেই ছবিগুলোর মধ্যে প্রথম স্থান সবসময়ই দখল করে থাকবে। এত ভালো অনুসন্ধানমূলক ছবি বাংলায় হয়েছে অথচ তার পর সেটিকে অনুসরণ করে পর পর আরও ছবি হয়নি, এটা ভারী আশ্চর্যের। ব্যবসা ভালো হলে একই ধাঁচের একাধিক ছবি পর পর হওয়ার ঘটনা বিরল নয়। তৎকালীন বাংলা চলচ্চিত্রের প্রায় সব বাঘা বাঘা অভিনেতারাই ছিলেন ছবিটিতে। অর্থাৎ, এমন একটি ছবি, যেখানে প্রতিটা সিনেই সাবিত্রী, বিকাশ রায়, উৎপল দত্ত, কমল মিত্র, পাহাড়ি সান্যালদের মতো দাপুটে অভিনেতারা পাল্লা দিচ্ছেন একে অপরকে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে উত্তম-শর্মিলা ঠাকুরের দৃশ্যগুলোই মনে হবে খানিকটা কাঁচা, যদিও তার একটি বড় কারণ অভিনেত্রীর অপেক্ষাকৃত কম বয়স এবং অনভিজ্ঞতা। নির্মাতা তাঁদের জুটিকে যে খুব রোম্যান্টিক হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন, তা-ও নয়। জোট বেঁধে গান নেই। গান থাকলেও তা হয় উত্তমের গলায় বিষাদের সুরে চোবানো একটি, অন্যটি শর্মিলা তার বুড়ো বাপের সামনে বারান্দায় বসে গায়।

গল্পটা সহজ। উত্তমের আগের পক্ষের স্ত্রী মারা গেছে এবং সে শর্মিলাকে বিয়ে করবে। বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, কারও কোনও আপত্তি নেই। হঠাৎ বিকাশ রায়ের আগমন। তাকে দেখেই মনে হয় ঠগ, এবং সে যে সাবিত্রীকে নিয়ে বড় দাঁও মারতে উদ্গ্রীব, তাও গোড়াতেই জেনে যাই আমরা। সাবিত্রীকে উত্তমের প্রথম পক্ষের বউ সাজালেই শুরু হয় গোলমাল, বিয়ের আসরে কমল মিত্র দুঁদে উকিল সেজে বিয়ে ভেস্তে দেয়। উত্তম জোর গলায় বলতে থাকে তার স্ত্রী মৃতা, সে আত্মহত্যা করেছে, আর কমল মিত্রের দাবি, সাবিত্রীই সেই স্ত্রী। জমজমাট কোর্টরুম সিনে উত্তম-কমল মিত্রের অভিনয়ের পাশে উৎপল দত্তকেও কিঞ্চিৎ মলিন দেখায়। শেষে দেখা যায় উত্তমই খুন করেছিল তার স্ত্রীকে। পাগল ছিল সেই মেয়ে। তার আর শর্মিলার মিলনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

উত্তম গোটা ছবিতে বার বার প্রশ্ন করে কেন বাকিরা তার পিছনে লেগেছে? সে কোনও প্রশ্নেরই উত্তর পায় না। আসলে সে এমন এক খুনি, যার কাছে প্রথম জীবনটার কোনও অস্তিত্বই নেই। সে আবার ঘর বাঁধতে চেয়েছে, আবার প্রেমে পড়েছে, ভালোবাসার ধরনটাও যার পাল্টায়নি কারণ সে প্রথমবার ঘর বাঁধার জন্যই বিয়ে করেছিল। এই খুন সম্পত্তির জন্য নয়। গোটা ছবি জুড়ে ঝকঝকে দেখায় তাকে। প্রথম স্ত্রীকে যেভাবে পর পর বিবাহবার্ষিকীতে উপহার দিয়েছে, সেভাবেই বিয়ের আগে থেকেই শর্মিলাকে উপহার দেওয়া শুরু করে সে। যেন আগের স্ত্রীর ভালোবাসার খানিকটা সে বহন করতে চায় এই জীবনেও। একবারই দোলাচলের ইঙ্গিত পায় দর্শক, যখন রেলগাড়ির চলমান আলোয় তার চোখে খানিকটা ভয় মিশ্রিত আশঙ্কার ছায়া ফুটে ওঠে। ছবির শেষে প্রমাণিত হয় সে খুনি। কিন্তু গোটা ছবি জুড়ে একবারের জন্যও তাকে কোনও কিছু গোপন করতে দেখা যায়নি। বরং সে নিজে গোড়া থেকে বিকাশ রায়কে নিয়ে ঘোরতর সন্দিগ্ধ হয়ে থাকে, পুলিশও লাগায় তার পিছনে।

সন্দেহ যাই হোক না কেন, গোটাটাই বিকাশ রায় সাবিত্রীর দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব নির্দেশকের প্রাপ্য। একেবারে ফিল্ম নোয়ার কায়দায় বানানো ছবি, উত্তমকুমারকে তৈরি করা হয়েছেও একেবারে সে আদলে। ছিপছিপে স্টাইলিশ পশ্চিমি পোশাকে আদবকায়দায় সে একেবারে নিখাদ হলিউডি চরিত্র। ইয়া পাকানো মোচ, গোল গোল ভাটার মতো চোখ পাকিয়ে চেঁচামেচি, তরোয়াল বের করে লাফালাফি কিচ্ছু নেই। তার কোনও আত্মীয় স্বজন নেই, থাকে একটা ফ্ল্যাটে, সফল ব্যবসায়ী এবং একটি খুনকে পিছে ফেলে এসেছে। মুছে দিয়েছে নিজের স্মৃতি থেকে। যেমন আধুনিক গল্প, তেমনি আধুনিক খলনায়ক। ভুলেই গেছিল কখনও খুন করেছে।

পাঠ: শৌণক সান্যাল

গল্প রেট করুন