অসমের যে সাহসী মানুষগুলো দীর্ঘকাল চিনা আগ্রাসন ঠেকিয়েছে, তাদের দিয়েই গড়ে তোলা হল, এক বিশেষ বাহিনী। অসমের মানুষই ড্রাগনের থাবা থেকে বাঁচিয়েছিলেন নিজেদের।
চারপাশে বেশ একটা যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব। আপনি হয়তো ভাবছেন, পুজো পুজোর গন্ধের মধ্যে যুদ্ধের বারুদের গন্ধ কোথা থেকে পেলাম? আসলে, লাদাখ সীমান্তের যা পরিস্থিতি, তাতে মুখে শান্তির আলোচনা চললেও যুদ্ধ যুদ্ধ আবহ বেশ জোরদার। শীতকালের কথা মাথায় রেখে লাদাখে সব রকম প্রস্তুতি সেরে রাখছে চিনা সেনা। এর মধ্যেই আবার খবর মিলেছে, লালফৌজের শিবিরে উপস্থিত হয়েছিলেন স্বয়ং চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। যুদ্ধের জন্য মানসিক ও শারীরিক, সব রকম প্রস্তুতি নিয়ে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। অর্থাৎ, যুদ্ধের সম্ভাবনা মোটেই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। আর সেই প্রসঙ্গে অবধারিত ভাবে উঠে আসছে ১৯৬২ সালের ইন্দো-চিন যুদ্ধের কথা। সেই যুদ্ধে ভারতের শোচনীয় পরাজয়ের পর উত্তর-পূর্বে গোপনে একটা গেরিলা বাহিনী তৈরির চেষ্টা হয়েছিল। আসুন তবে আজ সে গল্প শোনাই।
সম্প্রতি লাদাখে এক তিব্বতি সেনার মৃত্যু এবং তাঁর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্যের পর বার বার উঠে আসছে ‘স্পেশ্যাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স’ (এসএফএফ)-এর কথা। এই বিশেষ বাহিনীর অংশ ছিলেন ওই তিব্বতি সেনা। পাহাড়ে চড়ে লড়াইয়ে পটু এই বাহিনীর উপর বিশাল আস্থা ভারতের। ১৯৬২-এর লড়াইয়ের পর তিব্বতি যোদ্ধাদের নিয়ে এই বিশেষ বাহিনী গড়ে তোলে ভারত আর সেই বিশেষ বাহিনী পুরোটাই নিয়ন্ত্রিত হত ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি)-র অঙ্গুলিহেলনে, যার মাথায় তখন বসে রয়েছেন বি এন মল্লিক। তিব্বতের আধিকারিকদের গোপন সূত্র কাজে লাগিয়ে চিনের খবর বের করার ভার দেওয়া হয়েছিল এই বিশেষ বাহিনীর কাঁধে।
কিন্তু ১৯৭১-এ মল্লিক যে বই লেখেন, তাতে এই বিশেষ বাহিনীর উল্লেখ মাত্র মেলেনি। সম্ভবত চূড়ান্ত গোপনীয়তার কারণেই বাদ রাখা হয়েছিল এই চ্যাপ্টার, কিন্তু ‘মাই ইয়ার্স উইথ নেহরু: দ্য চাইনিজ বিট্রেয়াল’ বইতেই ঠিক একই রকম একটা বাহিনী তৈরির খসড়া মেলে, যে বাহিনী অসমের লোকজনকে নিয়ে গড়তে চেয়েছিলেন মল্লিক। সে এক অসাধারণ গল্প!
১৯৬২-এর ২০ অক্টোবর। চিনের কাছে ধাক্কার ক্ষত তখনও শুকোয়নি। তৎকালীন আইবি প্রধান মল্লিক খবর পেলেন উত্তর ও দক্ষিণ অসম থেকে সব সেনা প্রত্যাহার করার কথা ভাবছে ভারতীয় সেনা! সে সংক্রান্ত প্রস্তাব নাকি তারা সে দিনই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় পেশ করবে! কিন্তু সেটা হলে যে সমূহ বিপদ! তা আঁচ করেই তড়িঘড়ি লালবাহাদুর শাস্ত্রীর দ্বারস্থ হলেন মল্লিক। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বুঝিয়ে বললেন, ‘একবার আমরা অসম ছেড়ে এলে উত্তরবঙ্গকেও বাঁচানো যাবে না। অসম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, মণিপুরের জনবিন্যাস যদি দেখি, তাতে চিনারা একবার ঢুকে গেলে আর অসমকে ফিরে পাওয়া মুশকিল। পূর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ)-এর সঙ্গে সব সম্পর্ক তো ছিন্ন হবেই, চিন আর পাকিস্তান মিলে পুরো উত্তর-পূর্ব গিলে খাবে!’ সেই সঙ্গে মল্লিক বুঝিয়েছিলেন, অসমের মানুষ এমনিতেই চিনা আগ্রাসনের ভুক্তোভোগী। এ রকম একটা কঠিন সময় তাঁদের ছেড়ে চলে এলে ভারত আর কোন মুখে অসমকে নিজের বলে দাবি করবে! মল্লিকের যুক্তিসঙ্গত কথা মেনেছিলেন শাস্ত্রী। কিন্তু সঙ্গে এটাও বলেছিলেন, সেনা একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে সরকারের পক্ষে কিছু করা মুশকিল!
তা হলে উপায়?
বাড়ি ফিরে অনেক ভাবলেন আইবি প্রধান। ঠিক করলেন আইবি-র চাকরি ছেড়ে চলে যাবেন অসম। অসমের যে সাহসী মানুষগুলো এতদিন চিনা আগ্রাসন ঠেকিয়েছে, তাদের দিয়েই গড়ে তুলবেন এক বিশেষ বাহিনী। অসমের মানুষই ড্রাগনের থাবা থেকে বাঁচাবেন নিজেদের। নিজের পরিকল্পনার কথা জয়েন্ট ডিরেক্টরকে জানালেন মল্লিক। সাত-আট ব্যাটেলিয়ন সেনা সঙ্গে সঙ্গে সরানো হল জোড়হাটে। ঠিক হল, গুয়াহাটি-ডিব্রুগড় রেলওয়ে লাইনের দক্ষিণে অসমের স্পেশ্যাল ফোর্স গড়ার কাজ চালাবেন তাঁরা। নজরে ছিল বারাক উপত্যকাও। চিনারা যদি ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণ তীর ধরে আসে, জোড়হাট আর ডিব্রুগড় সেনাঘাঁটি সেনার আওতার বাইরে চলে যাবে। তখন কাজ করবে এই স্পেশ্যাল ফোর্স।
২১ নভেম্বর একটা লাঞ্চ মিটিংয়ে প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে সব কথা জানালেন মল্লিক। বললেন, পরদিন সকালেই অসম রওনা দিচ্ছেন তিনি। নেহরু বাধা দেননি, শুধু বলেছিলেন, ‘এখনই আইবি থেকে পদত্যাগ করবেন না। আর মাঝে মাঝে দিল্লি এসে খবর দেবেন।’ আপত্তি করেননি মল্লিক। নেহরু প্রস্তাব দিলেন বিজয় পট্টনায়েককে নিয়ে যাওয়ার। বিজয় নিজেই নাকি তার আগের দিন নেহরুর কাছে একই রকম একটা প্ল্যানের কথা বলছিলেন। ফলে, তাঁকে নিয়ে গেলে কাজটা সহজ হবে। তৎকালীন আর্মি কম্যান্ডার বি এম কউলকেও নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন নেহরু। কিন্তু মরার আগেই মরে যাওয়া মানসিকতার আর্মি কম্যান্ডারকে নিয়ে যেতে মোটেই রাজি হননি মল্লিক।
আশ্চর্যজনক ভাবে সেদিন সন্ধ্যার মন্ত্রিসভা বৈঠকে সেনা সরানোর প্রস্তাব পেশ করলেন না বাহিনীর প্রধান। কিন্তু মল্লিককে তাঁর প্ল্যান জারি রাখতে বললেন নেহরু। গুয়াহাটি, গোলাহাট, দিল্লির মধ্যে সব কথাবার্তা সারা। এর মধ্যে পট্টনায়েকের সঙ্গেও কথা বলেছেন মল্লিক, পরদিন ভোরে রওনা। ভোররাত তিনটের সময় পেকিং রেডিয়োয় ঘোষণা— চিনের তরফে সংঘর্ষবিরতি ঘোষণা করা হয়েছে। ভারত নতুন করে কোনও ঝামেলা না করলে ২১ নভেম্বর মধ্যরাত থেকেই সংঘর্ষবিরতি বলবৎ।
নেহরুর কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে তাঁকে সবটুকু জানান মল্লিক। জবাব এসেছিল, ‘জানতাম এমনটা হবে। চিন কূটনৈতিক ভাবে জিততে চাইছে, ওদের চিনি না!’ প্ল্যান কিন্তু বাতিল হয়নি। নেহরুর সঙ্গে আধ ঘণ্টা কথার পর পট্টনায়েক ও শাস্ত্রীকে নিয়ে রওনা দেন মল্লিক। পরদিন বেলা ১১টায় গুয়াহাটিতে পৌঁছন। সেখানের মানুষের মধ্যে তখন অদ্ভুত একটা আতঙ্ক। সে আতঙ্কে ভরসা জুগিয়েছিলেন মল্লিক-পট্টনায়েক-শাস্ত্রীরাই!
ফের কি তেমনই দিন ফিরছে? সীমান্তের পরিস্থিতি কিন্তু সে ইঙ্গিতই দিচ্ছে।