যখন সন্ধে হয়, তখনই Maa Kali-র ভয়

fontIcon
Kali
09 Nov 2023, 06:05:38 PM IST
Image Source: iStock

  • Kali Puja-র রাতে এই কালীর পুজো হয় না
  • দেবী বসে সাপের উপর, শিব মায়ের বৎস
  • এই কালীকে ইংল্যান্ড নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন হেস্টিংস
  • এঁকে পুজো করেছিলেন মহাভারতের জরাসন্ধ-ও
  • শেষ পর্যন্ত কেমন করে বীরভূমে এলেন সেই দেবী?

দীপান্বিতা অমাবস্যার রাত। চারিদিকে কালীপুজোর ধুমধাম। কিন্তু আকালীপুর ব্রাহ্মণী নদীর তীরে গাছতলায় পঞ্চমুণ্ডির আসন আর পাশের কালীমন্দিরে তখন শ্মশানের নীরবতা। সন্ধ্যারতির পর মন্দির বন্ধ। আসলে, এর পর ওই চত্বরে থাকার সাহস কারও নেই। দিনে ভক্তদের ভিড় থাকলেও সন্ধ্যার পরেই ঘটে অলৌকিক ঘটনা। মন্দির থেকে বেরিয়ে এসে ওই শ্মশানের মধ্যে ঘুরে বেড়ান মা গুহ্যকালী। কয়েকজন সাধক গোপন সাধনার সময়ে যাঁর সাক্ষী হয়েছেন। এমনটাই শোনা যায় ওই এলাকার মানুষদের থেকে।


তাঁর নামের মধ্যেই গুহ্য অর্থাৎ গোপন কথাটি লুকিয়ে। বীরভূমের আকালীপুরের এই গুহ্যকালীর সামনে দাঁড়ালে অবাক না হয়ে উপায় নেই। দেবীর পায়ের তলায় শিবের অস্তিত্ব নেই। তার বদলে সাপের কুণ্ডলীর উপরে ধ্যানাসনে বসে মা গুহ্যকালী। তাঁর কোমরে আর হাতের কঙ্কনে ফণা তোলা সাপের অলঙ্কার। কানের দুল হয়ে ঝুলছে দুটো মানবদেহ। বড় বড় চোখ আর বিশাল জিভ বার করা এই ভয়ংকর মূর্তির দিকে তাকালে দিনের বেলাতেই ভয়ের আবেশ তৈরি হয়।


মূর্তির বাঁ দিকে রয়েছেন শিব। এই মন্দিরে শিব দেবীর সন্তান হিসেবে পুজো পান। মহাকাল সংহিতা আর বিভিন্ন তন্ত্রে গুহ্যকালীর বর্ণনা মেলে। কিন্তু বাস্তবে এ-হেন কালীমূর্তির শুধু বাংলা কেন, সারা ভারতেও খোঁজ মেলা ভার। কেমন করে এল এই মূর্তি? শুধু পুরাণ নয়, কষ্টি পাথরের এই বিশাল কালীমূর্তির সঙ্গে জড়িয়ে কিছু বিস্মৃত ইতিহাসের কাহিনি। সেখানে আছেন মহাভারতের জরাসন্ধ থেকে ব্রিটিশ বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংসও।


সময়টা ১৭৭৫। বারাণসীতে তখন হুলুস্থুল। মহারাজ চৈত সিং-এর উপাসনার কালীমূর্তি রাতারাতি উধাও। এমন জাগ্রত মূর্তি চুরি হওয়ায় নড়েচড়ে বসেছে ব্রিটিশও। হেস্টিংস স্বয়ং তখন কাশীতে। চৈত সিং-এর বাড়িতেও তাঁর যাতায়াত। রাজার কাছ থেকে মূর্তি হারানোয় হেস্টিংস-এর আস্ফালনই যেন বেশি চোখে পড়েছিল।


কিন্তু, কেন?


আসলে, ওই মূর্তি সাহেবকে দেখিয়েই ভুল করেছিলেন চৈত সিং। সাহেবের চাহনি দেখেই বুঝতে পারেন ভুলটা। এক দিন তো কথায় কথায় বলেই ফেললেন হেস্টিংস! এমন সুন্দর কষ্টি পাথরের মূর্তির দাম প্রচুর। ভারতের একটা এঁদো জায়গায় এ সব পড়ে থাকার থেকে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে থাকলেই এর প্রকৃত সম্মান করা হবে। ব্যাপারটা বুঝতে বাকি রইল না চৈত সিং-এর।

ইংরেজদের সাহায্যেই ক্ষমতায় এসেছিলেন তিনি। তাই ইংরেজদের ইচ্ছা মানে তাঁর কাছে আদেশ। কিন্তু তাই বলে নিজের ইষ্ট দেবতাকে তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া? এ দিকে বাধা দেওয়ার রাস্তাও নেই। তাই বিশ্বস্ত কিছু অনুচরকে দিয়ে এক রাতে বাড়ি থেকে সরিয়ে দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছে গঙ্গার মধ্যে মূর্তি লুকিয়ে রাখেন তিনি। রটিয়ে দেন মূর্তি চুরির কথা।


অনেক খুঁজেও মূর্তির হদিস মেলে না। ব্যাপারটা ধীরে ধীরে থিতিয়ে যায়। কিন্তু সেই কালীমূর্তি তখন জলের তলা থেকেই অন্য এক কাহিনির সূচনা করে ফেলেছে। যার কেন্দ্র বীরভূমের ভদ্রপুর গ্রাম। এই গ্রামেই জন্ম মহারাজা নন্দকুমারের। প্রথমে মুঘল ও পড়ে ব্রিটিশদের দেওয়ান হয়ে তখন তাঁর দেশজোড়া খ্যাতি। তিনিই স্বপ্নে দেখলেন মা গুহ্যকালীকে। বারাণসীর গঙ্গায় পড়ে রয়েছেন মা। তাঁকে নিজের গ্রামে এনে প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দিলেন মা নিজে। তখন বারণসীতে রয়েছেন নন্দকুমারের কাকা রঘুনাথ। তাঁর সূত্রেই তিনি হাজির হলেন চৈত সিং-এর কাছে। মা-কে পুজো করতে না পেরে এমনিতেই মরমে মরেছিলেন চৈত সিং। বছর কয়েক আগে রাণী অহল্যাবাঈয়ের থেকে উপহার পেয়েছিলেন এই গুহ্যকালীর মূর্তি। সেখানেও এক স্বপ্নাদেশের কাহিনি। তবে সে বার কালী নয়, অহল্যাবাঈকে স্বপ্ন দিয়েছিলেন বাবা ভোলেনাথ। মাটির নীচ থেকে তাঁর লিঙ্গ উদ্ধার করার কথা বলেন তিনি। সেই লিঙ্গ খুঁজতে গিয়ে মাটি খুঁড়তেই উঠে আসে এই কালীমূর্তি। কালী উপাসক চৈত সিংকে যা উপহার দেওয়া হয়। অনেকের মতে, এই মূর্তির প্রথম পূজারী ছিলেন মহাভারতের জরাসন্ধ। ভীমের হাতে মৃত্যুর পরে তাঁর পাতালের মন্দির চাপা পড়ে যায়। সেই মূর্তিই নাকি উদ্ধার করেছিলেন অহল্যাবাই।


যাই হোক, এই মূর্তি গঙ্গার নীচে থাকার বদলে নন্দকুমারের হাতে পূজা হবে, এটা জানতে পেরে খুশিমনে মূর্তি উদ্ধার করে নৌকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন চৈত সিং। কারণ, স্থলপথে ব্রিটিশ পুলিশের ভয়। যে মূর্তি হেস্টিংসের নজরে পড়েছে, তার খোঁজ এক বার পাওয়া গেলে আর রক্ষা নেই। আর, নন্দকুমারের সঙ্গে তখন হেস্টিংসের মামলা চলছে কোর্টে। এর মধ্যেই গঙ্গা থেকে নদীপথে ব্রাহ্মণী নদীর তীরে জঙ্গলঘেরা এক শ্মশানে এসে হাজির হলেন নন্দকুমার। প্রথমে গাছতলায় এক পঞ্চমুণ্ডির আসনে প্রতিষ্ঠা করা হল গুহ্যকালীকে। তার পাশেই গোপনে শুরু হল মন্দির নির্মাণ।


ইতিমধ্যে হয়ে গেল চরম সর্বনাশ। হেস্টিংসের ষড়যন্ত্রে ওই মামলায় ফাঁসি হল নন্দকুমারের। মন্দিরের কাজ রয়ে গেল অসম্পূর্ণ। সেই আটকোনা অসম্পূর্ণ মন্দিরেই প্রতিষ্ঠিত হলেন গুহ্যকালী। কিন্তু, তন্ত্রমতে এই কালীকে খোলা আকাশের নীচে রাখাই বিধান। বাস্তবেও অল্প দিনের মধ্যেই বাজ পড়ে ফাটল দেখা গেল মন্দিরে। সম্পূর্ণ না হলেও মায়ের ঘর হল উন্মুক্ত। এই ফাটল মেরামতের কাজও নাকি পুরোহিতকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে বন্ধ করিয়েছিলেন গুহ্যকালী।


তেমন অবস্থাতেই আজও ইতিহাস, পুরাণ আর কিংবদন্তির কাহিনিতে মিলেমিশে অবস্থান করছেন গুহ্যকালী। নিত্যসেবার সঙ্গে রটন্তি কালীপুজোর সময়ে বিশেষ পুজোয় মেতে ওঠে এই শ্মশান। বিজ্ঞানের যুক্তি যা-ই বলুক, কালীপুজোর রাতে এই কালীকে পুজো করার সাহস আজও কেউ দেখাতে পারেনি।


কণ্ঠ:রূপা বসু


গল্প রেট করুন