ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু পড়ুয়াটিকে যেমন মনিটর বানিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন ক্লাসটিচার, তেমনই এক অনিষ্টকারী দেবতার কথা বলব আজ। যাকে বাগে আনতে কি না, বানিয়ে দেওয়া হলো মনিটর। বলছি গণেশের কথা।
শুরুটা করি, বৌদ্ধ দেবদেবীদের দিয়ে। বৌদ্ধ দেবতাদের মধ্যে একজন হলেন বিঘ্নান্তক। যার পায়ের তলায় দেখা যায়, গণেশকে। তা যাঁকে ছাড়া শুভ কাজের সূচনাই হয় না, তিনি কেন পায়ের তলায়? বৌদ্ধগ্রন্থ বর্ণনা দিচ্ছে, গণেশ নাকি এক সাধককে সিদ্ধিলাভের সাধনায় বাধা দিচ্ছিলেন। তাই সেই সাধকের অনুরোধে এমন বিঘ্নকারীকে দমন করতে আবির্ভূত হন বিঘ্নান্তক।
শুধু একজনই নয়, বৌদ্ধ দেবী পর্ণশবরীও পদদলিত করছেন গণেশকে। বাংলায় প্রাপ্ত এক মূর্তিতে সে রকমই দেখা যায়। গণেশকে আবার বৌদ্ধ দেবতা মহাকালের পদপিষ্ট হতেও দেখা গিয়েছে।
গণেশের প্রতি বৌদ্ধ দেবদেবীদের এমন আচরণ কেন? হয়তো হিন্দু-বৌদ্ধ সংঘাতের ইঙ্গিত দেয় এই মূর্তিগুলি। তবে শুধু বৌদ্ধধর্মেই নয়, গণেশের এমন বৃত্তান্ত কিন্তু আরও বেশি প্রাচীন।
গণেশ, অর্থাৎ গণের দেবতা। এই গণ কি শিবের সাঙ্গপাঙ্গ না জনগণ? প্রাচীন সমাজকে তো গণ বলেও উল্লেখ করা হতো। অতুলচন্দ্র গুপ্ত কিন্তু তাই বলছেন, গণেশ জনসঙ্ঘের দেবতা। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, ‘আদিতে গণেশ ছিলেন কর্মসিদ্ধির দেবতা নয়, কর্মবিঘ্নের দেবতা।’ মিল পাওয়া যাচ্ছে ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু বাচ্চাটার সঙ্গে?
মহাভারতে গণেশ বা গণপতি প্রসঙ্গে বহুবচনের প্রয়োগ দেখা যায়। গণেশের আর একটি প্রচলিত নাম বিনায়ক। এই বিনায়কও কিন্তু বহুবচনে ব্যবহৃত হয়েছে মানবগৃহ্যসূত্র পুঁথি বা যাজ্ঞবল্ক্য আইনে। সেখানে বিনায়ক তথা গণেশদের যে ছবি আঁকা হয়েছে, তা ভয়ই জাগায়।
গণেশদের বা বিনায়কদের দৃষ্টি পড়লে যে ভয়াবহ মানসিক অবস্থা সৃষ্টি হয়, তারই বিস্তৃত বর্ণনা আছে সেখানে। কী রকম? কোনও মারাত্মক দুঃস্বপ্ন থেকে উন্মাদরোগও হতে পারে গণেশদের দৃষ্টি পড়লে। এখানেই শেষ নয়, তাঁদের প্রভাবে রাজার ছেলে উপযুক্ত হলেও রাজ্য পায় না। কুমারীর বর জোটে না। ঋতুমতী নারীর সন্তান হয় না। সন্তান আছে যার, তাকে সন্তানহারা হওয়ার যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। বিদ্বানদের শিষ্য জোটে না, আবার শিষ্যদের বিদ্যালাভ হয় না। চাষাবাদ বা ব্যবসা মূহূর্তে ভণ্ডুল হতে পারে বিনায়কদের দৃষ্টিপাতে।
এই যে বিনায়কদের দৃষ্টি পড়লে এত কিছু হয়, তাতে খানিক শনির দৃষ্টির সঙ্গে মিল পাওয়া যাচ্ছে না? তা পরিচিত গল্প তো বলে, শনির দৃষ্টিপাতেই নাকি খসে পড়েছিল গৌরীপুত্রের মাথা। আর এই গ্রন্থগুলি পড়লেই মনে আসে, বিঘ্নকর্তা নামে যার পরিচিতি, সেই গণেশ এত বিঘ্ন ঘটাতে পারেন?
অতুলচন্দ্র গুপ্ত মনে করিয়ে দিচ্ছেন, গণেশের যে পূজা তা ছিল এই ভয়ঙ্কর দেবতাটিকে শান্ত রাখার জন্য, তিনি কাজকর্মের উপর যাতে দৃষ্টি না দেন, সে জন্য ঘুষের ব্যবস্থা। অর্থাৎ ভক্তিতে নয়, মূলত ভয়ে পুজো। তন্ত্রসাহিত্যে গণেশের কয়েকটি পুরোনো নাম: বিঘ্নেশ, বিঘ্নকৃৎ, বিঘ্নরাজ, বিঘ্নেশ্বর ইত্যাদি। অর্থাৎ ট্রাবল মেকার। অবশ্য বিঘ্ন দূর করেন বলে এহেন নাম বলে একটা ব্যাখ্যা দেওয়া যায় বটে, কিন্তু যেখানে গণেশের নাম স্রেফ বিঘ্ন? তাতে তো এইটে স্পষ্ট হয় যে, তিনি নিজেই বিঘ্ন ঘটান।
বৈদিক সাহিত্যে গণপতির উল্লেখ আছে, কিন্তু তার গজাননের উল্লেখ নেই। তান্ত্রিক সাহিত্যে গণেশের বহু চিত্তাকর্ষক নামের মধ্যে কয়েকটি হলো, বৃষভধ্বজ, দ্বিজিহ্ব (দুই জিভ অর্থাৎ সাপ?), বৃষকেতন ইত্যাদি। নামগুলি হাতির বদলে ষাঁড় এবং সাপের কথাই মনে পড়ায়।
আনন্দস্বামী কুমারস্বামী মনে করাচ্ছেন, হাতির মাথা বসানো গণেশের এই মূর্তিটি ভারতে প্রচলিত হতে শুরু করেছে মূলত গুপ্তযুগ থেকে। তবে কি তার আগে অন্য কারও মাথা ছিল সেখানে?
গণেশের ধড়ে হাতির মাথা আসলে তো হাতির টোটেমের কথাই মনে করায়। এমন নয় তো যে, এত যে অহিতকারী নানা টোটেমধারী বিনায়ক, তার মধ্যে কোনও একজনেরই হঠাৎ দেবত্বপ্রাপ্তি হলো? যার কি না হাতির টোটেম। অর্থাৎ ক্লাস মনিটর করে দেওয়া হলো? অহিতকারীকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে জাতে উঠিয়ে হিতকারী করা। এ বার তো তাঁর উত্তরণের পালা। তাই এক সময় তাঁর নামে শুরু হলো প্রবল প্রচার। নারদপুরাণে বলা হলো গণেশস্তোত্র লিখে লিখে বিলি করতে। তাঁর বিদ্যা ও জ্ঞানের গৌরব প্রচার করা হলো। তাঁর নাম না নিয়ে কোনও শুভ কাজ হবে না। পুজো শুরু হবে না। মহাভারতের লিপিকার হয়ে উঠলেন তিনি। রচিত হলো গণেশগীতা, যা আগাগোড়া গীতারই মতো, শুধু কৃষ্ণের বদলে গণেশের নাম তাতে।
পার্বতী গায়ের ময়লা দিয়ে গণেশকে গড়েছিলেন। তার পরের গল্প তো সকলেরই জানা। বহুলচর্চিত। তবে আরেকটি স্বল্প পরিচিত গল্প বলে, পার্বতী স্নানের সময় তেলের সঙ্গে নিজের গায়ের ময়লা মিশিয়ে মালিনী নামে এক গজাননা রাক্ষসীকে খাওয়ান। তারই ফলে মালিনীর গর্ভে গণেশের জন্ম। যাকে পরে পার্বতী গ্রহণ করেন। তা হলে রাক্ষসকূলজাত বিঘ্নকর্তা ‘জাতে উঠে’ হলেন বিঘ্নহর্তা? প্রচলিত গল্পগুলিও কিন্তু গণেশের মাথা পাল্টানোর কথাই বলে। অর্থাৎ চেঞ্জ। আদি অকৃত্রিম নন তিনি। কিছু চেঞ্জের মধ্য দিয়ে তো গিয়েইছেন।
মনু সংহিতায় গণেশ শূদ্র বা ‘শূদ্রানাং গণনায়কঃ’। রাক্ষসীর গল্পটি যদি বাদও দিই, গণেশজননী কিন্তু তাঁকে গায়ের ময়লা দিয়ে গড়েছেন। দেবতারা সরাসরি গর্ভজাত হন না ঠিকই, কিন্তু এমন নোংরা থেকে জন্ম নিতেও শোনা যায় না কাউকে।
এখানে আরও একটি কাহিনির উল্লেখ প্রয়োজন। সোমনাথ পাহাড়ে দলে দলে নারী ও শূদ্ররা শিবের কাছে যাচ্ছে দেখে ভীত হয়ে পড়েন ইন্দ্র এবং অন্য দেবতারা। এত জন তথাকথিত ‘মানবেতর’ পূণ্য অর্জন করে ফেললে যে সর্বনাশ! তাঁদের অনুরোধ শিব উড়িয়ে দিলে, তাঁরা পার্বতীর শরণাপন্ন হন এবং তাদের মুশকিল আসানেই পার্বতী বিঘ্নেশ্বরকে সৃষ্টি করেন। এটাও কথিত যে, বেশি জন পূণ্যলাভ করলে স্বর্গরাজ্যে স্থান অকুলান হবে। তাই গণেশের অন্যতম কাজ সম্পদের লোভ দেখিয়ে মানুষকে সিদ্ধিলাভের পথ থেকে ভ্রষ্ট করা। তবু ধীরে ধীরে সেই তিনিই কিন্তু সিদ্ধিদাতায় উন্নীত হলেন। যে শূদ্ররা শিবপুজো দিতে গেলে স্বর্গরাজ্য ভীত হয়ে পড়ে, সেই শূদ্রদের গণনায়কই একাসনে বসলেন দেবতাদের সঙ্গে।
এই প্রসঙ্গেই বলি, গণেশের আরও একটি নাম দ্বিদেহকও। অর্থাৎ যার দুইটি দেহ। মানে দুইটি সত্ত্বা। একদিকে তিনি বিঘ্ন ঘটান, আবার তিনি বিঘ্ন দূর করে সিদ্ধিও দেন। অর্থাৎ বিঘ্নকর্তা থেকে বিঘ্নহর্তা হয়ে তিনি হয়ে উঠলেন সিদ্ধিদাতা।
পাঠ: রূপা বসু
Eisamay Gold/spirituality/how did lord ganesha become siddhidata from buddhist villain