আগুনের মাঝে ধ্যানে মগ্ন যোগী

fontIcon
FIRE
10 Aug 2020, 07:00:00 PM IST
Image Source: iStock

গুরুভাইয়ের লাগানো আগুনের মাঝে ধ্যানমগ্ন তিনি। গ্রামের মানুষেরা দেখলেন সেই যোগীকে ভাবলেশহীন ভাবে ধ্যানের শেষে চোখ মেলতে। এতটুকু উদ্বেগ নেই চোখে মুখে। সেই মহাসাধক রামদাসকে অভিবাদন জানিয়েছিলেন ব্রিটিশ সিপাইরাও। সেই কাঠিয়াবাবার না জানা কিছু কাহিনি।

তখন মধ্যরাত। এখনকার উত্তরাখণ্ডের সীমান্তে পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট একটি গ্রাম। সেই গ্রামের পাশেই ঘন জঙ্গল। ঘোর অমাবস্যায় সেখানেই পঞ্চধুনি জ্বালিয়ে সাধনায় বসেছেন এক যোগীপুরুষ। পাশে আছেন তাঁরই এক গুরুভাই। যোগসাধনার এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছেন সেই যোগী যেখানে চারপাশ সম্পর্কে সমস্ত জ্ঞান লুপ্ত হয়ে যায়।

কিন্তু, গুরুভাইটি রীতিমতো সজাগ। মাঝে মাঝেই চোখ খুলে দেখে নিচ্ছে, পাশে সেই যোগী ঠিক কতটা ডুবে গিয়েছেন ধ্যানে। শেষে যখন বুঝল, এতটাই গভীর সেই ধ্যান যে চারপাশের কোনও জ্ঞানই তাঁর নেই, তখন আলতো করে চারদিকে তাকিয়ে সে উঠে দাঁড়ালো। তবু খটকা যায় না। যোগীর সামনে গিয়ে দেখতে চাইল, সত্যিই ধ্যানে ডুবে গিয়েছেন তো! যোগী বুঝতেও পারলেন না। তিনি তখন নিবিড় ধ্যানে মগ্ন। এর পর গুরুভাইটি পা টিপে টিপে গিয়ে চারপাশ থেকে জঙ্গলের শুকনো কাঠ, পাতা এনে জড়ো করল যোগীপুরুষের চার দিকে। বলতে গেলে, একটা স্তূপের মতোই বানিয়ে ফেলল প্রায়। এমন ভাবেই জড়ো করল স্তূপ, যাতে ধ্যান ভাঙলেও যোগী কোনও ভাবেই সেখান থেকে বেরোতে না পারেন। ধ্যানমগ্ন যোগীর কিন্তু ভ্রূক্ষেপই নেই।

এ বার জড়ো করা কাঠ পাতায় আগুন লাগিয়ে চুপচাপ সেখান থেকে সরে পড়ল সেই গুরুভাই। বহুদিন থেকে এই মুহূর্তটির অপেক্ষায় ছিল সে। যোগীর যেমন সাধনক্ষমতা, তেমনই তিনি জনপ্রিয়। গুরুভাইটি বুঝে গিয়েছিল, ছক কষে এঁকে খুন করতে না পারলে কেউ তার দিকে ফিরেও তাকাবে না। তাই, সময় বুঝে যোগীকে আগুনে পুড়িয়ে মারার বন্দোবস্ত।

ও দিকে যোগীজি তখন ঈশ্বর-সাধনায় বাহ্যজ্ঞান হারিয়েছেন। চারপাশে জড়ো করা কাঠ আর শুকনো পাতার স্তূপ তখন দাউ দাউ করে জ্বলছে। মাঝখানে নিশ্চল বসে আছেন তিনি। আশপাশের শুকনো ডালপালায় ছড়িয়ে ক্রমেই আরও বাড়তে থাকল সেই আগুন। দূর থেকে আগুনের শিখা দেখে গ্রামের লোকজন প্রথমে ভাবল, জঙ্গলে আগুন লেগেছে বুঝি! তার পর দৌড়ে এসে দেখল, চারদিকে জ্বলছে ভয়ংকর আগুন আর তারই ঠিক মাঝখানে বসে আছেন ধ্যানমগ্ন সেই যোগী। সারা রাত ধরে তারা চেষ্টা করল যাতে আগুন নিভিয়ে যোগীকে বের করে আনা যায়। পারল না। ধোঁয়ায় ঢেকে গেল চারদিক।

another fire

একটু একটু করে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করল। চারপাশে পাখিদের কলরব, দূরে কোনও মন্দির থেকে ভেসে আসছে ঘণ্টার ধ্বনি, ধোঁয়া তখনও পাক খেয়ে উঠছে আকাশের দিকে। কিন্তু এ কী আশ্চর্য দৃশ্য! গ্রামের মানুষরা পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে দেখল‌, ধ্যান ভেঙে চোখ মেললেন যোগী। নির্লিপ্ত সেই দৃষ্টিতে কোথাও এতটুকু উদ্বেগ নেই। নিভে যাওয়া আগুনের ধংসস্তূপের মধ্যে থেকে উঠে এলেন তিনি। সবাইকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘শোন, ঈশ্বর-সাধনায় মন ঢেলে দিতে পারলে জগতের কোনও কিছুই তোদের ক্ষতি করতে পারবে না’।

এই বিস্ময় পুরুষই হলেন মহাসাধক রামদাস, সাধারণ মানুষের কাছে যিনি কাঠিয়াবাবা নামে পরিচিত। মহাযোগী বাবা দেবদাসের কাছে দীক্ষিত এই যোগীপুরুষ কঠিন তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন।

যোগীবর জাগতিক চাওয়াপাওয়া নিয়ে উদাসীন ছিলেন বটে, কিন্তু স্বদেশচেতনা ছিল প্রবল। ছোট্ট একটি গল্প থেকেই তা ধরা যাবে।

একদিন কাঠিয়াবাবা আগ্রায় যমুনার তীর ধরে আপন মনে হেঁটে যাচ্ছেন। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সাহেবদের ছোট একটা রণতরী। সময়টা তখন বেশ অস্থিরই বলা যায়। দেশে সিপাহী বিদ্রোহ চলছে। ফলে, ব্রিটিশ সৈন্যরা এ দেশের মানুষদের উপর বিরক্ত। ভারতবাসী দেখলেই গালমন্দ করে অপমান করছে।

যোগীজিকেও তারা ছাড়ল না। জাহাজের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ভেসে এল ভারতীয়দের সম্পর্কে অশ্রাব্য গালাগাল। কাঠিয়াবাবা সেই সব কথায় কোনও কান না দিয়ে আপন মনে হেঁটে চললেন। তাতে ব্রিটিশ সিপাইদের মনে হল, সাধক তাদের কোনও গুরুত্বই দিচ্ছেন না। প্রচণ্ড রেগে এক গোরা সিপাই যোগীকে লক্ষ করে গুলি ছুড়ল। কাঠিয়াবাবার কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেল সেই গুলি।

এ বার ফিরে তাকালেন শান্ত, নিরুত্তাপ সেই সাধক। গোরা সৈনিকদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘ওই বন্দুক দিয়ে তোরা এ দেশের কোনও ক্ষতিই করতে পারবি না! ওরে মূর্খের দল, কাউকে গুলি করার আগে ভালো করে বন্দুকটা ধরতে শেখ...’।

নিমেষে আশ্চর্য এক কাণ্ড ঘটে গেল। গোরা সেনাদল চমকে উঠে দেখল, গুলি ছুড়েছিল যে, সেই দক্ষ সৈনিকটির হাত কাঁপছে আর বন্দুকটাও পড়ে গিয়েছে যমুনা নদীতে। গোরা সেনার দল বুঝল, আপনমনে হেঁটে যাওয়া সাধকটি যে-সে মানুষ নয়। তারা সবাই জাহাজ থেকে নেমে এসে টুপি খুলে কাঠিয়াবাবাকে অভিবাদন জানাল। আশপাশ থেকে ভেসে এলো ভক্তদের জয়ধ্বনি — জয় কাঠিয়াবাবার জয় ...।

গল্প রেট করুন