একটু একটু করে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করল। চারপাশে পাখিদের কলরব, দূরে কোনও মন্দির থেকে ভেসে আসছে ঘণ্টার ধ্বনি, ধোঁয়া তখনও পাক খেয়ে উঠছে আকাশের দিকে। কিন্তু এ কী আশ্চর্য দৃশ্য! গ্রামের মানুষরা পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে দেখল, ধ্যান ভেঙে চোখ মেললেন যোগী। নির্লিপ্ত সেই দৃষ্টিতে কোথাও এতটুকু উদ্বেগ নেই। নিভে যাওয়া আগুনের ধংসস্তূপের মধ্যে থেকে উঠে এলেন তিনি। সবাইকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘শোন, ঈশ্বর-সাধনায় মন ঢেলে দিতে পারলে জগতের কোনও কিছুই তোদের ক্ষতি করতে পারবে না’।
এই বিস্ময় পুরুষই হলেন মহাসাধক রামদাস, সাধারণ মানুষের কাছে যিনি কাঠিয়াবাবা নামে পরিচিত। মহাযোগী বাবা দেবদাসের কাছে দীক্ষিত এই যোগীপুরুষ কঠিন তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন।
যোগীবর জাগতিক চাওয়াপাওয়া নিয়ে উদাসীন ছিলেন বটে, কিন্তু স্বদেশচেতনা ছিল প্রবল। ছোট্ট একটি গল্প থেকেই তা ধরা যাবে।
একদিন কাঠিয়াবাবা আগ্রায় যমুনার তীর ধরে আপন মনে হেঁটে যাচ্ছেন। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সাহেবদের ছোট একটা রণতরী। সময়টা তখন বেশ অস্থিরই বলা যায়। দেশে সিপাহী বিদ্রোহ চলছে। ফলে, ব্রিটিশ সৈন্যরা এ দেশের মানুষদের উপর বিরক্ত। ভারতবাসী দেখলেই গালমন্দ করে অপমান করছে।
যোগীজিকেও তারা ছাড়ল না। জাহাজের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ভেসে এল ভারতীয়দের সম্পর্কে অশ্রাব্য গালাগাল। কাঠিয়াবাবা সেই সব কথায় কোনও কান না দিয়ে আপন মনে হেঁটে চললেন। তাতে ব্রিটিশ সিপাইদের মনে হল, সাধক তাদের কোনও গুরুত্বই দিচ্ছেন না। প্রচণ্ড রেগে এক গোরা সিপাই যোগীকে লক্ষ করে গুলি ছুড়ল। কাঠিয়াবাবার কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেল সেই গুলি।
এ বার ফিরে তাকালেন শান্ত, নিরুত্তাপ সেই সাধক। গোরা সৈনিকদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘ওই বন্দুক দিয়ে তোরা এ দেশের কোনও ক্ষতিই করতে পারবি না! ওরে মূর্খের দল, কাউকে গুলি করার আগে ভালো করে বন্দুকটা ধরতে শেখ...’।
নিমেষে আশ্চর্য এক কাণ্ড ঘটে গেল। গোরা সেনাদল চমকে উঠে দেখল, গুলি ছুড়েছিল যে, সেই দক্ষ সৈনিকটির হাত কাঁপছে আর বন্দুকটাও পড়ে গিয়েছে যমুনা নদীতে। গোরা সেনার দল বুঝল, আপনমনে হেঁটে যাওয়া সাধকটি যে-সে মানুষ নয়। তারা সবাই জাহাজ থেকে নেমে এসে টুপি খুলে কাঠিয়াবাবাকে অভিবাদন জানাল। আশপাশ থেকে ভেসে এলো ভক্তদের জয়ধ্বনি —
জয় কাঠিয়াবাবার জয় ...।