গভীর রাতে উজ্জ্বল আলো, গুরুকে দেখলেন সন্তদাস

fontIcon
spiritual one  Krishnendu Chaki
15 Mar 2021, 07:00:00 PM IST
Image Source: BCCL

আইনজীবী তারাকিশোর চৌধুরী তথা সন্তদাস বাবাজীর সঙ্গে তাঁর গুরু কাঠিয়াবাবার সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ঐশ্বরিক। সূক্ষ্ম দেহে এসে তিনি শিষ্যের ঘুম ভাঙিয়ে দিতেন। সাধনার পথে চালিত করতেন। ছবিতে জ্যান্ত হয়ে ধরা দিতেন গুরু, শিষ্যের সঙ্গে মাততেন ঐশ্বরিক আনন্দে।

সাধকের সাধন-জীবন জুড়ে থাকে তার গুরু। যে গুরুর মাধ্যমে তিনি পৌঁছে যান মহাশক্তিমান ঈশ্বরের কাছে, তাই গুরুই সাধকের কাছে একমাত্র পথপ্রদর্শক। দুর্গম, বন্ধুর পথের সব বিপদ, ভুলগুলোকে চিনিয়ে দিয়ে শিষ্যের মাথায় ছাতা ধরে রাখে তার গুরু। গুরু-শিষ্যের এই সম্পর্ক নিবিড়, নিরন্তর। এই সম্পর্কের সঠিক বিন্যাসে তৈরি হয় অধ্যাত্মিক দর্শন, যে দর্শন মানুষকে মুক্তির পথ দেখায়।

আইনজীবী তারাকিশোর চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর গুরু মহাসাধক কাঠিয়াবাবার সম্পর্কও যেন এক নতুন দর্শনের খোঁজ দেয়, যেখানে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই ঈশ্বরের ছোঁয়া, অধ্যাত্মিক আবেশ। নিষ্ঠা, ত্যাগ এবং কঠোর অনুশাসনের মধ্যে দিয়ে আর্থিকভাবে সম্পন্ন, মেধাবী আইনজীবী তারাকিশোরের মহাসাধক সন্তদাস হয়ে ওঠার কাহিনির প্রতিটি পরতে লুকিয়ে আছে ঈশ্বরের আশীর্বাদ, গুরু কাঠিয়াবাবার লীলাখেলা।

অধুনা বাংলাদেশের শ্রীহট্ট জেলার বনেদি জমিদার পরিবারের অত্যন্ত মেধাবী তারাকিশোর সাফল্যের সঙ্গে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে কলকাতায় এসে ব্রাহ্ম সমাজে যোগ দেন। রক্ষণশীল ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন সমাজকে বদলে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে, কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে শুরু হয় তার সমাজসংস্কার আন্দোলন। মেধাবী তারাকিশোর এই আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যেই এমএ পাশ করে সিটি কলেজে অধ্যাপনায় যোগ দেন। এক দিকে পড়াশোনা আর অন্য দিকে মানুষের মন থেকে কুসংস্কারের অন্ধকারকে দূর করার ব্রত নিয়ে তারাকিশোর ওকালতি পড়তে থাকেন। কিছুদিনের মধ্যেই ওকালতিতে নাম করে ফেলেন তারাকিশোর, সেই সময়ের নামী উকিলরাও তার বিপক্ষে সওয়াল করার আগে দু’বার ভাবতেন। পেশাদার সেই উকিল তারাকিশোর চৌধুরীই যোগীরাজ কাঠিয়াবাবার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে হয়ে উঠলেন মহাসাধক সন্তদাস বাবাজী।

বিচিত্র এই গুরুশিষ্যের লীলাখেলা, যেখানে গুরুর আশীর্বাদে শিষ্য শূন্য থেকে পূর্ণ হয়ে ওঠে। গুরুর নির্দেশ মেনে সাধক তারাকিশোর শেষ রাতে ঘুম থেকে উঠে কাঠিয়াবাবার নাম নিয়ে সাধন ভজন করেন। সাধনার একেবারে শুরুর দিকে মাঝরাতে তারাকিশোরের ঘুম ভাঙত না। সেই সময় কাঠিয়াবাবা সূক্ষ্ম দেহে স্বয়ং এসে শিষ্যের ঘুম ভাঙিয়ে দিতেন।

এক বার, সারা দিনের কায়িক পরিশ্রমে ক্লান্ত তারাকিশোর রাতে অকাতরে ঘুমোচ্ছেন। শেষ রাতে সাধনার সময় কখন যে পার হয়ে গেছে, সেটা তিনি বুঝতেই পারেননি। হঠাৎ তাঁর গায়ে একটা পাথরের টুকরো এসে পড়ল। চমকে উঠে বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলেন তারাকিশোর। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ঘরে জানালা দিয়ে চারদিকে উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে পড়ল। সেই আলোয় তারাকিশোর দেখতে পেলেন তার গুরু কাঠিয়াবাবাকে। মৃদু হেসে তিনি তার শিষ্যকে বলছেন, ‘ক্লান্তি আর সাধনা দুই বিপরীত মেরুর শব্দ। একটা থাকলে আর একটা পালিয়ে যায়’।

এর পর থেকে শেষরাতে ঘুম থেকে উঠতে তার আর কোনও সমস্যা হয়নি।

সাধন ভজনকালে ঠাকুরঘরে তাঁর গুরুর ছবি মাঝেমাঝেই জীবন্ত হয়ে উঠত। ওই ছবির মধ্যে স্বয়ং গুরু এসে ধরা দিতেন। শিষ্যের সঙ্গে নাচতেন, গাইতেন। সেই মুহূর্তে মহাযোগী কাঠিয়াবাবা এবং সাধক সন্তদাস এক অতীন্দ্রিয় লোকে বিরাজ করতেন যেখানে পার্থিব সব কিছুই নিমিত্ত হয়ে যেত।

Spiritual two Krishnendu Chaki

ক্রমে সাধক সন্তদাস হয়ে উঠলেন সাধারণ মানুষের ভরসাস্থল। তৈরি হল সন্তদাস বাবাজীর আশ্রম। সেখানে একটি মন্দিরে ঈশ্বরের বিগ্রহ স্থাপন করলেন সন্তদাস বাবাজীর গুরু কাঠিয়াবাবা। বিগ্রহ স্থাপন শেষ হলে গুরু তাঁকে বললেন, ‘তোমার আশ্রমে ঈশ্বরের অধিষ্ঠান হয়েছে, যাও ভগবানের কাছে বর চেয়ে নাও, উনি তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করবেন’। সাধক সন্তদাস বললেন, ‘গুরুদেব আপনার সন্তোষই আমার একমাত্র প্রার্থনা’।

কাঠিয়াবাবা আনন্দে আপ্লুত হয়ে শিষ্যের মাথায় স্নেহের হাত রেখে বললেন, জানি বেটা, তোমার গুরুভক্তি শিক্ষণীয়, তবু ভগবানও তোমাকে কিছু দিতে চায়, যাও যা মন চায় তার কাছ থেকে নিয়ে নাও’।

সন্তদাস বাবাজী বিগ্রহের সামনে এগিয়ে গিয়ে জোড় হাত করে বললেন, ‘ দয়াময়, তুমি গীতায় সেই ব্রহ্মের সন্ধান দিয়েছ, যাঁর শোক- আকাঙ্ক্ষা-দুঃখ-বেদনার অনুভূতি নেই। যিনি সর্বভূতে সমদর্শী। আমাকে তুমি কৃপা করে সেই অবস্থানে নিয়ে চলো’।

সে দিন, আইনজীবী তারাকিশোর থেকে সন্তদাস হয়ে ওঠা সাধকের মাথায় হাত রেখে গুরু কাঠিয়াবাবা বলেছিলেন, ‘তোমার অভিষ্ট সিদ্ধ হবে, তুমি ভগবৎ দর্শন করবে। তুমি মোহান্ত হয়ে উঠবে’।

আপ্লুত সন্তদাস কাঠিয়াবাবার পায়ে পড়ে আনন্দে কাঁদতে লাগলেন।

গল্প রেট করুন