তখনও কোর্টের কাজকর্ম শুরু হয়নি। চারদিকে ক্রমশ ব্যস্ততা বাড়ছে, কিন্তু উকিলরা সব গেলেন কোথায়? পক্ষ, প্রতিপক্ষ, ন্যায়ালয়ের কেরানি বা সাধারণ মানুষ— সকলেই উকিলদের খুঁজছে, কিন্তু কেউ তাদের খুঁজে পাচ্ছে না। অনেক খোঁজার পর দেখা গেল হাইকোর্টের নবীন প্রবীণ সব উকিল ব্যারিস্টারেরা বার লাইব্রেরিতে জড়ো হয়েছেন। সেই সময়ের প্রখ্যাত আইনজীবী তারাকিশোর চৌধুরী হাইকোর্ট ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে যাচ্ছেন। এমন নয় যে, তিনি কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর নিয়ে চলে যাচ্ছেন, তাই সবাই এসেছেন তাঁকে বিদায় জানাতে। আসলে বিখ্যাত আইনজীবী তারাকিশোর চৌধুরী তাঁর বাড়ি, আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য বৃন্দাবনে চলে যাচ্ছেন। ওকালতির ব্যস্ত জীবন, সুখ, সমৃদ্ধি, সামাজিক প্রতিপত্তি সব কিছু ছেড়ে তারাকিশোর বেছে নিয়েছেন সাধকের জীবন। ঈশ্বরের সাধনায় নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিবেদন করতে চান তিনি।
উপস্থিত সকলের মন ভারাক্রান্ত, কারওর কারওর চোখে জল। তারাকিশোর সকলের মাঝখানে একটি চেয়ারে বসে আছেন। অভিবাদন পর্ব শেষ হওয়ার পর প্রবীণ আইনজীবী স্যর রাসবিহারী ঘোষ তারাকিশোরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁকে দেখে তারাকিশোর দাঁড়িয়ে উঠলেন। কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে স্যার রাসবিহারী ঘোষ মাথা নিচু করে তারাকিশোরকে প্রণাম করতে গেলেন। তারাকিশোর চমকে উঠে তাঁকে ধরে নিয়ে বললেন, ‘ছি ছি! আপনি এ কী করছেন? আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ, আমাদের শিক্ষক... আপনি আমাকে...’
স্যর রাসবিহারী বললেন, ‘তারা, তুমি আমাকে বাধা দিয়ো না। আমি বয়োজ্যেষ্ঠ এটা যেমন সত্যি, ঠিক তেমন ভাবে তুমি জ্ঞানবৃদ্ধ এটাও সত্যি। যে মানুষ তাঁর সম্ভাবনাময় জীবনকে অবহেলায় ছুড়ে ফেলে বৃন্দাবনে ঈশ্বরের পায়ে নিজেকে সঁপে দিতে চলেছে সেই মানুষ সাধারণ মানুষ নয়। আমি সেই মানুষের পদধূলি নিচ্ছি যিনি একজন মহাসাধক’।
সে দিন সকলের সামনে স্যর রাসবিহারী, যে মানুষটির পায়ের ধুলো নিয়েছিলেন তিনিই পরবর্তীকালে ভারতের আধ্যাত্মিক আকাশে মহাসাধক সন্তদাস বাবাজী নামে উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন।
বৃন্দাবনের আশ্রমে সাধনজীবনে নিজেকে নিবেদন করে আইনজীবী তারাকিশোর ক্রমে এক সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হয়ে উঠলেন, তার অতীত গরিমা, প্রতিষ্ঠা, বিত্ত ইত্যাদি সব কিছুকে ত্যাগ করলেন। গুরু কাঠিয়াবাবার সেবা এবং মানুষের কল্যাণ সাধনে নিজের জীবন উৎসর্গ করলেন মহাসাধক সন্তদাস। একটু একটু করে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন সন্তদাস।