অভুক্ত মেথর! সন্তদাসের নির্দেশে ফের শুরু হল রান্না

fontIcon
ADHTYMA ONEKRISHNENDU CHAKI
21 Mar 2021, 07:00:00 PM IST
Image Source: BCCL

সাধনার জন্য গৃহী জীবন ছেড়ে দিয়ে বৃন্দাবনে রওনা হলেন তারাকিশোর চৌধুরী। পরবর্তীকালে নাসিক কুম্ভমেলায় বৈষ্ণবদের এই চারটি সম্প্রদায়ের প্রধান হলেন তিনি। তৈরি হল আশ্রম। শুরু হল সেবা।

তখনও কোর্টের কাজকর্ম শুরু হয়নি। চারদিকে ক্রমশ ব্যস্ততা বাড়ছে, কিন্তু উকিলরা সব গেলেন কোথায়? পক্ষ, প্রতিপক্ষ, ন্যায়ালয়ের কেরানি বা সাধারণ মানুষ— সকলেই উকিলদের খুঁজছে, কিন্তু কেউ তাদের খুঁজে পাচ্ছে না। অনেক খোঁজার পর দেখা গেল হাইকোর্টের নবীন প্রবীণ সব উকিল ব্যারিস্টারেরা বার লাইব্রেরিতে জড়ো হয়েছেন। সেই সময়ের প্রখ্যাত আইনজীবী তারাকিশোর চৌধুরী হাইকোর্ট ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে যাচ্ছেন। এমন নয় যে, তিনি কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর নিয়ে চলে যাচ্ছেন, তাই সবাই এসেছেন তাঁকে বিদায় জানাতে। আসলে বিখ্যাত আইনজীবী তারাকিশোর চৌধুরী তাঁর বাড়ি, আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য বৃন্দাবনে চলে যাচ্ছেন। ওকালতির ব্যস্ত জীবন, সুখ, সমৃদ্ধি, সামাজিক প্রতিপত্তি সব কিছু ছেড়ে তারাকিশোর বেছে নিয়েছেন সাধকের জীবন। ঈশ্বরের সাধনায় নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিবেদন করতে চান তিনি।

উপস্থিত সকলের মন ভারাক্রান্ত, কারওর কারওর চোখে জল। তারাকিশোর সকলের মাঝখানে একটি চেয়ারে বসে আছেন। অভিবাদন পর্ব শেষ হওয়ার পর প্রবীণ আইনজীবী স্যর রাসবিহারী ঘোষ তারাকিশোরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁকে দেখে তারাকিশোর দাঁড়িয়ে উঠলেন। কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে স্যার রাসবিহারী ঘোষ মাথা নিচু করে তারাকিশোরকে প্রণাম করতে গেলেন। তারাকিশোর চমকে উঠে তাঁকে ধরে নিয়ে বললেন, ‘ছি ছি! আপনি এ কী করছেন? আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ, আমাদের শিক্ষক... আপনি আমাকে...’

স্যর রাসবিহারী বললেন, ‘তারা, তুমি আমাকে বাধা দিয়ো না। আমি বয়োজ্যেষ্ঠ এটা যেমন সত্যি, ঠিক তেমন ভাবে তুমি জ্ঞানবৃদ্ধ এটাও সত্যি। যে মানুষ তাঁর সম্ভাবনাময় জীবনকে অবহেলায় ছুড়ে ফেলে বৃন্দাবনে ঈশ্বরের পায়ে নিজেকে সঁপে দিতে চলেছে সেই মানুষ সাধারণ মানুষ নয়। আমি সেই মানুষের পদধূলি নিচ্ছি যিনি একজন মহাসাধক’।

সে দিন সকলের সামনে স্যর রাসবিহারী, যে মানুষটির পায়ের ধুলো নিয়েছিলেন তিনিই পরবর্তীকালে ভারতের আধ্যাত্মিক আকাশে মহাসাধক সন্তদাস বাবাজী নামে উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন।

বৃন্দাবনের আশ্রমে সাধনজীবনে নিজেকে নিবেদন করে আইনজীবী তারাকিশোর ক্রমে এক সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হয়ে উঠলেন, তার অতীত গরিমা, প্রতিষ্ঠা, বিত্ত ইত্যাদি সব কিছুকে ত্যাগ করলেন। গুরু কাঠিয়াবাবার সেবা এবং মানুষের কল্যাণ সাধনে নিজের জীবন উৎসর্গ করলেন মহাসাধক সন্তদাস। একটু একটু করে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন সন্তদাস।

ADHTYMA TWO KRISHNENDU CHAKI


নাসিক কুম্ভমেলায় নিম্বার্ক, শ্রী, বিষ্ণু-স্বামী ও মাধ্ব— বৈষ্ণবদের এই চারটি সম্প্রদায়ের মোহান্তরাই উপস্থিত হয়েছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই এমন এক যোগ্য মানুষকে চাইছেন যিনি সর্বসম্মতভাবে এই চার সম্প্রদায়ের প্রধান হবেন। মহাসাধক সন্তদাসও সেখানে গিয়েছেন। তিনি তখন তাঁর ভক্ত শিষ্যদের নিয়ে তিনি সাধারণ মানুষের সেবা করতে ব্যস্ত। বৈষ্ণব মহন্তরা তাঁকেই সম্প্রদায়ের প্রধান ঠিক করলেন। সেই দিনই নাসিকে বৈষ্ণবদের মহাসম্মেলন থেকে সর্বসম্মতিক্রমে আচার্য সন্তদাস বাবাজীর নাম প্রধান মোহান্ত রূপে গৃহীত হল। কুম্ভমেলায় উপস্থিত মোহন্ত ও সাধারণ বৈষ্ণবরা নিয়ম মেনে তাঁদের নেতাকে বরণ করে নিলেন।

বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের প্রধান মোহন্ত হওয়ার পর সন্তদাস বৈষ্ণবদের ধর্মীয়ভাবে সঙ্ঘবদ্ধ করার কাজ শুরু করেন। দেশের আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলে তাঁর গুরুত্ব ও প্রভাব বাড়তে থাকে। তাঁর গুরু কাঠিয়াবাবার নির্দেশ মেনে তিনি সব সাধকদের এক ছাতার তলায় আনার ব্রত গ্রহণ করেছিলেন। যোগীরাজ ভোলাগিরির মতো মহাসাধকও তার অস্তিত্বকে ভীষণ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন। তাঁর কাছে, মানুষের জাত, ধর্ম, বর্ণের থেকে মানবিকতা ও মূল্যবোধই মুখ্য বিষয় ছিল।

এক বার তাঁর আশ্রমে হঠাৎই বাইরে থেকে বেশ কিছু সাধক আতিথ্য গ্রহণ করেন। স্বাভাবিক ভাবেই আশ্রমের দুপুরের খাবার কম পড়ে যায়। পরে সন্তদাস জানতে পারেন যে খাবার শেষ হয়ে যাওয়ার জন্য আশ্রমের মেথররা খাবার পাননি। প্রচণ্ড রেগে গিয়ে সন্তদাস তৎক্ষণাৎ নির্দেশ দেন ‘এক্ষুনি মেথরদের জন্য আহারের ব্যবস্থা করো। ওরা আজ এখান থেকে না খেয়ে যাবে না। অতিথিদের জন্য আমি আমার আশ্রমের নিয়ম ভাঙতে পারব না’।

বাবাজীর নির্দেশ মতো তক্ষুনি রান্না করে মেথরদের পেট ভরে খাইয়ে আপ্যায়ন করা হয়। সেই সময় সমাজের চোখে ম্লেচ্ছ মানুষগুলোর চোখে তখন জল, তাঁরা মহাসাধক সন্তদাস বাবাজীকে প্রণাম করে চিৎকার করে বলে উঠল— জয় সন্তদাস বাবাজীর জয়, জয় সন্তদাস বাবাজীর জয়।

গল্প রেট করুন