Raslila Special: রাসলীলা লিখে বসলেন শিবচন্দ্র

fontIcon
Raslila Special
25 Nov 2023, 05:42:56 PM IST
Image Source: Wikipedia

  • ভক্তসাধক কাঙাল হরিনাথ আর তরুণ শিবচন্দ্র ছিলেন গভীর বন্ধু
  • হরিনাথের কাছেই তাঁর হাতেখড়ি
  • শিবচন্দ্রকে হরিনাথ বলেন কৃষ্ণলীলা মাধুর্যের রসের কথা
  • বলেন, তা সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে
  • তার পর? কী করে বসলেন শিবচন্দ্র?

সর্বমঙ্গলা মন্দিরে সে দিন বেশ ভিড়। আশপাশের গ্রাম তো বটেই, দূর-দূরান্ত থেকেও বহু মানুষ এক পণ্ডিত সাধকের কথা শুনতে এসেছেন। শাস্ত্রের কঠিন তত্ত্বগুলো সহজ সরলভাবে মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করা এবং মানুষকে সঠিক পথ দেখানোই তাঁর কাজ। মানুষ তাঁর কথাকে ভরসা করে, বিশ্বাস করে।

সেই সময় পণ্ডিত রাধাবিনোদ গোস্বামীর বয়স খুবই কম। দিদিমার হাত ধরে তিনিও সেদিন সর্বমঙ্গলা মন্দিরে এসেছেন। শাস্ত্রের ভারী ভারী কথা এবং তার ব্যাখ্যা শুনতে তার ভালো লাগছিল না। কিশোর বয়সে সেটাই স্বাভাবিক। রাধাবিনোদ দু-একবার দিদিমাকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা বললেও দিদিমা শুনতে পেলেন না, তিনি তখন সাধকের কথা মোহিত হয়ে শুনছেন। বাধ্য হয়ে রাধাবিনোদও সাধকের কথা শুনতে লাগলেন। সাধকের দু-একটি ব্যাখ্যা শোনার পর তারও ভালো লাগতে শুরু করল। কিন্তু তার বলার ভঙ্গিতে তিনি অবাক হলেন। সাধক শাস্ত্র ব্যাখ্যা করতে করতে কখনও হাসছেন, কখনও তার চোখে জল আবার কখনও তিনি ‘জয় তারা’... ‘জয় তারা’ বলে চিৎকার করে উঠছেন। কিছুক্ষণ শোনার পর রাধাবিনোদ আর চুপ করে থাকতে পারলেন না, সাধকের বক্তব্যকে থামিয়ে তিনি বলে বসলেন, ‘বেশ তো বলছেন কিন্তু মাঝে মাঝে অমন চিৎকার করছেন কেন ? এতে তো শ্রোতাদের অসুবিধা হচ্ছে’।

সভায় উপস্থিত সবাই চমকে উঠলো, সামান্য এক বালক তন্ত্রাচার্য শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব’কে থামিয়ে দিল ? এখন কী অনর্থ ঘটবে কে জানে! রাধাবিনোদও তখন তার ভুল বুঝতে পেরেছে, ক্ষনিকের আবেগে সে মারাত্মক সমস্যা তৈরি করে ফেলেছে, এখন কী হবে কে জানে !

কিছুক্ষণ চারদিকে অপরিসীম নীরবতা। একটা পিন পড়লেও তার শব্দ পাওয়া যায়। সাধক শিবচন্দ্র চোখ খুলে তাকালেন। তার দু’চোখ বেয়ে তখন জলের ধারা নেমে আসছে। শান্তভাবে তিনি বালক রাধাবিনোদকে বললেন, ‘ঠিক বলেছিস তুই, এত চিৎকার করেও কোন ফল হয় না, মা’এর কানে আমার চিৎকার পৌঁছয় না। আমি যে তার চরণে আশ্রয় চাই’।

বলতে বলতে তাঁর দু-চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতেই তিনি গেয়ে উঠলেন,

‘নিশাচরে দিবাচরে, সমান হবে চরাচরে, দিবাকর নিশাকর করে আলোক আঁধার হবে
কবে গো আনন্দময়ী ! এ দীনে সে দিন দিবে ? যে দিন দিন রাত্রি হবে, রাত্রি আবার দিন হবে’।


শুধুমাত্র শাস্ত্রব্যাখ্যা নয়, অধ্যাত্ম দর্শনকে জনমানসে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন তন্ত্রাচার্য শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব। সেই সময় তিনি ছিলেন এক সামাজিক আন্দোলনের প্রতিনিধি, যাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করে সমাজে আসে চেতনা, মূল্যবোধ। পুরনো ধ্যানধারণাকে আঁকড়ে না থেকে মানুষ নতুন করে ভাবার সুযোগ পায়।

প্রবীন ভক্তসাধক কাঙাল হরিনাথ ও তরুণ শিবচন্দ্র অভিন্নহৃদয় বন্ধু ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তারা খুবই অন্তরঙ্গ ছিলেন। কাঙাল হরিনাথের কাছেই শিবচন্দ্রের হাতেখড়ি হয়। পরবর্তীকালে শিবচন্দ্র কাঙাল হরিনাথকে তার বিশেষ পরামর্শদাতা হিসেবে সম্মান দিতেন। এর জন্য তিনি সমাজের জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতাকে ভেঙে ফেলে কাঙাল হরিনাথকে সর্বমঙ্গলা আশ্রমে তাঁর পাশে স্থান দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য।

বঙ্কিমচন্দ্র সেই সময় যুক্তি ও আধুনিকতা দিয়ে কৃষ্ণচরিত্রকে ব্যাখ্যা করেন। সেই ব্যাখ্যা শিবচন্দ্র মেনে নিতে পারলেন না, বঙ্কিমচন্দ্রের ভাবনার বিপক্ষে শাস্ত্রগত যুক্তি দিয়ে তিনিও কৃষ্ণচরিত্রের ব্যাখ্যা লিখে প্রথমেই কাঙাল হরিনাথকে পড়ালেন। হরিনাথ সেই ব্যাখ্যা পড়ে অবাক হয়ে গেলেন। এত পাণ্ডিত্য! যুক্তির এমন অসাধারণ ব্যবহার! তিনি শিবচন্দ্রকে বললেন, ‘দেখো তোমার এই লেখাকে অসাধারণ বললে কম বলা হবে। কিন্তু একজনের লেখাকে মাথায় রেখে তুমি তোমার সৃষ্টি করবে কেন? তুমি শক্তিমান সাধক, তত্ত্বও জানো। সামান্য একজন সমালোচক হিসেবে তুমি জন্মাওনি, ও সব তোমার কাজ নয়, তোমার কাজ সৃষ্টি করা.. তুমি সৃষ্টি করে যাও। কৃষ্ণলীলা মাধুর্যের রস সর্বসাধারণের কল্যাণে পরিবেশন করো’।

শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব কাঙাল হরিনাথের পরামর্শ মেনে নিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই রচনা করলেন ‘রাসলীলা’। পরমপুরুষ তত্ত্বের লীলারসের ধারায় তৃপ্ত হলো সাধারণ মানুষ। জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষ আজও এই বইটিকে কৃষ্ণ-দর্শনের অন্যতম প্রধান বই হিসেবে গণ্য করে থাকেন।


পাঠ: শৌণক সান্যাল

গল্প রেট করুন