Adi Ganga : চাঁদ সওদাগর থেকে জীবনানন্দ…আদি গঙ্গার অজানা কাহিনি

fontIcon
ADIGANGA
06 Dec 2023, 11:01:50 AM IST
Image Source: Wikipedia

  • আদিগঙ্গার তীরে নৌকার হাট ছিল বাঁশদ্রোণীতে
  • চেতলায় এই নদীর পাড়ে আজও বিক্রি হয় মাছ ধরার জাল
  • কালীঘাট-চেতলার মধ্যে নদী পেরোনোর নৌকোগুলো আর নেই
  • চাঁদ সদাগর বাণিজ্যে গিয়েছিলেন এই নদী দিয়েই
  • কবি জীবনানন্দ দাশ আবার ভয়ে পেরোলেন না নদী
  • কিন্তু সেই নদীই যে আর নেই, টালি নালায় পরিণতণত

Historical journey of Adiganga : নৌকা ছিল। নৌকা নেই। মাত্র বছর পনেরো আগেও আদি গঙ্গায় ছিল নৌকা পারাপারের ব্যবস্থা। চেতলার লোকজন অনায়াসে সেই নৌকায় উঠে পৌঁছতেন কালীঘাটের সাবিত্রী ঘাটে। তা বলে নৌকা কিন্তু চলত না। আদি গঙ্গায় নৌকা দাঁড়িয়ে থাকত। অথচ সেই নৌকায় উঠেই এ পার-ও পার করা যেত। ব্যাপারটা কী রকম?


তখন প্রতি বছর ঘাটের পালা ডাকে, মানে এক ধরনের টেন্ডার বা দরপত্র ব্যবস্থায় অংশ নিতেন মাঝিরা। ডাকে উঠত ঘাটের দর। ট্যাঁকের কড়ি ফেলে কোনও এক মাঝি এক বছরের জন্য ‘কিনে নিতেন’ ঘাট। ফের ঘাটের ডাক ওঠার আগে পর্যন্ত সেই ‘মালিক মাঝি’ সার দিয়ে তিন-তিন খানা নৌকা আড়াআড়ি দাঁড় করিয়ে রাখতেন আদি গঙ্গার উপর। সেতুর মতো দাঁড়িয়ে থাকা নৌকার উপর দিয়ে চলত হেঁটে আদি গঙ্গা পারাপার। এই পারানির কড়ি ছিল মাত্র ৫০ পয়সা। আজ তার কোনও চিহ্ন নেই। নৌকায় করে এমন পারাপার উঠে গিয়েছে। সেখানে এখন সেতু তৈরির ব্যবস্থা হচ্ছে। নদীর ঘাটের কাছ থেকে নৌকা সরে গিয়েছে অনেক দূরে। নৌকা সরে যায়। নৌকা মুছে যায়। আদ্যিকাল শ্যাওলা হয় ঘাটের গায়ে। ঘাটের শরীরে লেগে থাকা সেই শ্যাওলার গায়েও জমে থাকে অনেক গল্প। যা নিয়েই বয়ে চলে নদী।


আদি গঙ্গা লাগোয়া একটি জমজমাট তল্লাট এখন বাঁশদ্রোণী। আজ এই ভূখণ্ডের আকাশ বহুতল অট্টালিকার সারি দিয়ে ঢাকা। লোকে বলে, এই বাঁশদ্রোণীতে এক সময়ে বসত নৌকার হাট। বাঁশের নৌকা হাটে কেনা-বেচা হতো। বাঁশদ্রোণী নামের মধ্যেই রয়েছে সেই ইতিহাস। দ্রোণী শব্দের অর্থ তরী বা নৌকা। আর বাঁশের নৌকা মানে বাঁশদ্রোণী। সেই থেকেই বাঁশদ্রোণী নামের সূত্রপাত। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসতেন নৌকা কিনতে। বাঁশদ্রোণীর বাঁশের নৌকার খ্যাতি ছিল নৌকা ব্যবসায়ীদের কাছে। নৌকা কিনে, সেই নতুন নৌকায় চেপে কত মানুষ যে আদি গঙ্গা ধরে পাড়ি দিতেন গন্তব্যে! কালের নিয়মে, অবহেলায়, দূষণে আদি গঙ্গা ক্ষীণস্রোতা হতে হতে পর্যবসিত টালিনালায়। নদী থেকে নালায় হয়েছে তার অবক্ষয়। আদিগঙ্গা দিয়ে নৌকা যেত, এখন টালিনালার উপর বুক বিদীর্ণ করে বসানো পিলারের উপর বিছোনো ট্র্যাক দিয়ে ছুটে যায় মেট্রো রেল।


তবু শ্যাওলার মতো গল্প ভেসে যায় আদ্যিকালের সেই নদীর গায়ে। এক পাড়ে কালীঘাট, অন্য পাড়ে চেতলা। চেতলা হাটে আজও বিক্রি হয় মাছ ধরার জাল। ওই হাটের মশারির সুখ্যাতি গোটা দেশ জুড়ে। বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন এসে কিনে নিয়ে যান মশারি। নদী পাড়ের বেশ কয়েক জনের কাছ থেকে শোনা গেল, চেতলার হাট থেকে জাল কিনে জেলের দল মাছ ধরতে যেতেন নৌকা করে। শুধু জাল নয়, জালের কাঠি, বঁড়শি, ছিপও বিক্রি হতো চেতলার হাটে। এখানকার পটুয়াপাড়ায় তৈরি মাটির পাত্র, কলসি, কুঁজোর কদরও ছিল বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে। গাং বেয়ে নৌকা করে বিক্রির জন্য বাংলার বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হতো সেই সব মাটির পাত্র।


জনশ্রুতির নানা পথে আজও বহমান আদি গঙ্গা। যেমন, এই পথ দিয়েই ভেসে গিয়েছিল চাঁদ সওদাগরের নৌকা। বেহুলার ভেলাও নাকি ভেসে লখিন্দরকে নিয়ে স্বর্গপথে পাড়ি দিয়েছিল এই জলপথ দিয়ে। তবে আদি গঙ্গার ঘাটে ঘাটে থান পুজোর রীতি ছিল। আজও গড়িয়া, বৈষ্ণবঘাটা, রথতলার অনেক জায়গাতেই বিভিন্ন দেবদেবীর থান। যার মধ্যে রয়েছে মনসার থান, শীতলার থান, ওলা বিবির থান। এই সব তল্লাটের বহু মানুষ আজও মনস্কামনা পূরণ করতে থানে পুজো দেন। বৈষ্ণবঘাটার ওলা বিবির থানে এখনও মাটির ঘোড়া দিয়ে, প্রদীপ জ্বালিয়ে পুজো দিয়ে যান সব ধর্মের মানুষ। স্থানীয়দের একাংশের বক্তব্য, নৌকায় যাতায়াত করতেন সব ধর্মের মানুষ এবং সেই সূত্র ধরেই এই সব রীতির প্রচলন।


শুধু কি তা-ই? আদিগঙ্গার সঙ্গে যে জড়িয়ে কবি জীবনানন্দ দাশের কথাও!


চাকরি নেই কবির। স্ত্রী লাবণ্যর সামান্য রোজগার আর রোজগেরে ভাইয়ের আর্থিক সাহায্যে কোনও রকমে চলে সংসার। পকেটের এমন হাল যে, প্রতি মাসে ল্যান্সডাউন রোডের বাড়িভাড়ার টাকা টুকু দেওয়াও আত্মভোলা কবির পক্ষে হয়ে দাঁড়ায় কষ্টকর। নিরুপায় কবি ভাবেন বাসা বদলের কথা। তাঁর সেই ভাবনার কথা জানান পরিচিত এক দালালকে। খোঁজ করতে বলেন ঠিক কলকাতা নয়, তবে কলকাতার কাছাকাছি কোনও বসতবাড়ির, যেখানে উঠে যাওয়া যাবে অল্প ভাড়ায়। সেই দালাল জানান, টালিগঞ্জের কাছে পুটিয়ারিতে মিলতে পারে অল্প টাকায় ভাড়া বাড়ি। সেই কথা শুনে দালালের সঙ্গে একদিন সেই বাড়ি দেখতে পুটিয়ারির পথে রওনা দেন জীবনানন্দ। দু’জনে পৌঁছন টালিগঞ্জের করুণাময়ীতে। তখন আদি গঙ্গার উপর বাঁশ দিয়ে তৈরি এক সাঁকো। লিকলিকে, রোগা, নড়বড়ে সাঁকো। পুটিয়ারি যেতে হলে ওই বাঁশের উপর দিয়ে হেঁটে আদি গঙ্গা পার করতে হবে। দালালের পিছু পিছু জীবনানন্দ বাঁশের ওই সরু সাঁকো দিয়ে কয়েক পা এগোন পুটিয়ারির দিকে। তবে কিছুটা গিয়েই তিনি আবার ফেরত চলে আসেন করুণাময়ীতে। সেই দালাল ভদ্রলোককে কবি বলেন, ‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই ভাবে রোজ রোজ বাঁশের সাঁকো দিয়ে নদী পেরোনো যাবে না। তাই, এখানে থাকা হবে না।’


কবি জীবনানন্দ দাশের জীবন অবলম্বনে লেখা প্রদীপ দাশশর্মার উপন্যাস ‘নীল হাওয়ার সমুদ্রে’-তে উল্লেখ আছে ওই ঘটনার।


আজও এমন করেই গল্প বলে চলে আদি গঙ্গার জলl


কণ্ঠ: শৌণক স্যান্যাল


গল্প রেট করুন